বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ইউসিবিতে শেয়ারধারী পরিচালক ও অন্য দুটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
ইউসিবির নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের। ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ছিল এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা সম্পর্কে মামা-ভাগনে ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী। তিন ব্যাংকেই তাঁদের বড় অঙ্কের ঋণ ও তাঁদের নিয়োজিত জনবল রয়ে গেছে।
আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা পাঁচটি ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এর আগে ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়।
তিন ব্যাংকে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশে বলা হয়েছে, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিত করা ও জনস্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে পরিচালনা পর্ষদ নতুনভাবে গঠনের জন্য পাঁচজনকে পরিচালক/স্বতন্ত্র পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য থেকে চেয়ারম্যানও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
# কৌশল করেও টিকল না ইউসিবি।# ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণ ২৬ হাজার কোটি টাকা। যার বড় অংশ খেলাপি।# গ্লোবাল ইসলামীর ঋণ ১৩ হাজার কোটি টাকা, প্রায় সবই এস আলমের।
সরকার পরিবর্তের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যাঁরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেননি, তাঁদের ছাড় দেওয়া হবে না। টাকা উদ্ধারে আইনগত যত পন্থা আছে, সবই অনুসরণ করা হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে। এর ধারাবাহিকতায় আজ পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইউসিবির চেয়ারম্যান পদে আজ সকালে পরিবর্তন আনে ব্যাংকটি। ইউসিবির চেয়ারম্যান করা হয় স্বতন্ত্র পরিচালক অপরূপ চৌধুরীকে। এর আগে ১৬ আগস্ট ব্যাংকটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল রোকসানা জামান চৌধুরীকে। তিনি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বোন। তাঁর আগে চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান।
ব্যাংকটির একটি সূত্র জানিয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী ব্যাংকটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের এ সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মন রক্ষা হয়নি। আজ সন্ধ্যায় আগের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে দুজন শেয়ারধারী পরিচালক ও তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিচালক দুজন হলেন শরীফ জহীর ও মো. তানভীর খান। বাকি তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসেন, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মো. ইউসুফ আলী ও হিসাববিদ ওবায়দুর রহমান।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর কিছু শেয়ারধারী ব্যাংকের বাইরে বিক্ষোভ করেন। সে সময় ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন করা হয়।
ইউসিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পারটেক্স গ্রুপ। কিন্তু ২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের প্রতিনিধিদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন রুকমিলা জামান। তবে রুকমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরীই পরিচালনা করে আসছিলেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে ইউসিবির কিছু শেয়ারধারী অভিযোগ করেন, রুকমিলা জামান ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেও সাইফুজ্জামান চৌধুরী কার্যত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের কারণে’ ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ার পথে। ওই চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে; যা এই ‘ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা লুট করে পরিশোধ করা হয়েছে’।
ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে অনন্ত গ্রুপ ও পারটেক্স গ্রুপের কয়েকজন প্রতিনিধি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেখা করে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানান।
২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে ইউনিয়ন ব্যাংক। এ ব্যাংক যা ঋণ দিয়েছে, তার বেশির ভাগই ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব ঋণ এস আলম গ্রুপের বলেই জানিয়েছেন ব্যাংক দুটির ঋণ বিভাগের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে ইউনিয়ন ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানায়, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য; যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যত ঋণ বিতরণ করেছে, তার সিংহভাগই খেলাপি বা অনিয়মযোগ্য। পরে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এখন ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। ঋণের টাকা আদায় না হওয়ায় ব্যাংকটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। এরপরও ব্যাংকটির লেনদেন নিয়মিত রয়েছে। তবে এখন তা সীমিত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন আগে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ভাই রাশেদুল আলমসহ পরিবার ও গ্রুপটির কর্মকর্তারা ব্যাংকটির পরিচালক পদে রয়েছেন।
আজ নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যান করা হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক এমডি মু. ফরীদ উদ্দিন আহমদকে। তাঁর সঙ্গে থাকা অপর চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম জাহীদ ও হিসাববিদ শেখ জাহিদুল ইসলাম।
২০১৩ সালে যাত্রা করে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক)। কিছুদিন পর গ্লোবাল ইসলামীতে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে। এ ব্যাংক যা ঋণ দিয়েছে, তার বেশির ভাগই ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব ঋণ এস আলম গ্রুপের বলেই জানিয়েছেন ব্যাংক দুটির ঋণ বিভাগের কর্মকর্তারা।
পি কে হালদারের সময় বিভিন্ন নামে টাকা বের করে নেওয়ার পর ব্যাংকটি আর খুব একটা ঋণ বিতরণ করেনি। বছরের পর বছর এসব ঋণ আর আদায় হয়নি। প্রতিবছর সুদযুক্ত হয়ে তা শুধু বাড়ছে। গত বছর শেষে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৪১ কোটি টাকা, যার ১২ হাজার কোটি টাকার সুবিধাভোগী এস আলম গ্রুপ।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান প্রবাসী নিজাম চৌধুরী, পরিচালক পদে রয়েছেন সাইফুল আলমের ভাই শহীদুল আলম, ভাইয়ের স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজন। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমও ব্যাংকটির পরিচালক।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিনকে। তাঁর সঙ্গে থাকা অপর চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. জামাল মোল্লা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক ডিএমডি নুরুল ইসলাম খলিফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক আবু হেনা রেজা হাসান ও হিসাববিদ মু. মাহমুদ হোসেন।