রপ্তানি আয় নেই বা কম—এমন আমদানিকারকদের ঋণপত্র খোলা নিয়ে ব্যাংকগুলোয় দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য অনেক সময় তাঁদের উচ্চমূল্যে ঋণপত্র খুলতে হচ্ছে। শতভাগ নগদ টাকা জমা দিতে হচ্ছে। এরপরও চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছেন না তাঁরা। ফলে, তাঁদের সংকটও কাটছে না।
তবে রপ্তানি আয় আছে—এমন আমদানিকারকেরা ডলার-সংকটের মধ্যেও ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা নিয়ে স্বস্তিতে আছেন। কারণ, তাঁদের আয় দিয়েই আমদানি দায় মেটানো যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো ডলারের দাম আটকে রাখলেও সংকটে পড়া আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হচ্ছে না। কারণ, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ডলারের বেশি দাম দিতে হচ্ছে তাঁদের। আরও বেশি দাম দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। আবার আরও দাম বেড়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কাতেও কেউ কেউ দ্রুত আমদানির উদ্যোগ নিচ্ছেন। এই তালিকায় রয়েছেন খাদ্যপণ্য, রড-সিমেন্ট, ইলেকট্রনিকস, মুঠোফোন, নির্মাণ, পরিবহনসহ আরও কয়েকটি খাতের ব্যবসায়ীরা।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ কারণে দেশের আমদানি খরচও বেড়ে যায়। এতে আমদানি খরচ প্রতি মাসে ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে একই হারে বাড়েনি রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। শুরু হয় ডলারের সংকট। এ কারণে ডলারের দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. সরোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তদারকির ফলে আমদানি চাপ কমে এসেছে। ব্যাংকগুলোর ডলারের মজুত বেড়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘোষিত মূল্য রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে ১০৫ টাকা, প্রবাসী আয়ে ১০৭ টাকা। ফলে, আমদানিতে খরচ ১০৬ থেকে ১০৭ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে এই দাম নির্ধারণ করেছে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দাম কার্যকর হচ্ছে রপ্তানি আয় আছে—এমন আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে। কারণ, বাকি অনেক আমদানিকারক ডলারের দাম ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা পরিশোধ করছেন—এমন তথ্য মিলছে।
দেশের শীর্ষ চারটি ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জরুরি খাদ্যপণ্য আমদানিকারক দুটি শীর্ষ গ্রুপ ১১৪ টাকা দরে ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধ করেছে। এর কারণ হিসেবে একটি ব্যাংক বলছে, অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনে আনতে হচ্ছে। এতে আনুষ্ঠানিক দামের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক খরচও আছে। এই খরচ তো গ্রাহককেই দিতে হবে। একই অবস্থা মোটরসাইকেল, গাড়ি, প্লাস্টিকসহ কয়েকটি খাতের আমদানিকারকদের।
আবার নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্ট রড, সিমেন্টের আমদানিকারকদেরও ঋণপত্র খুলতে ডলারের বেশি দাম দিতে হচ্ছে। জানতে চাইলে মেট্রোসেম সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ শহীদউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছি না। অনেক ব্যাংক বাইরে থেকে ডলার সংগ্রহ করার শর্তে খুলছে। এতে দাম ধরছে ১১৩ থেকে ১১৪ টাকা। এরপরও ডলার মিলছে না। ফলে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’
আমরা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছি না। অনেক ব্যাংক বাইরে থেকে ডলার সংগ্রহ করার শর্তে খুলছে। এতে দাম ধরছে ১১৩ থেকে ১১৪ টাকা। এরপরও ডলার মিলছে না। ফলে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’মুহাম্মদ শহীদউল্লাহ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেট্রোসেম সিমেন্ট
একই রকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে কৃষি খাতের যন্ত্রপাতি আমদানিকারকদেরও।
ট্যাফে ব্র্যান্ডের কৃষিযন্ত্র আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছি না। ফলে, কৃষিযন্ত্র আমদানি করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব ঋণপত্র খোলা গেছে, এর কয়েকটি ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারে দিতে হয়েছে ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। অথচ আমদানিতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১০৭ টাকার মধ্যে।’
ঋণপত্র খোলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি আরোপ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদারকি জোরদার ও চাহিদামতো ঋণপত্র না খোলায় আমদানি ব্যয় ইতিমধ্যে কমে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয় ছিল ৫১৪ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কম। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমদানি খরচ ছিল ৮৩২ কোটি ডলার। আমদানি বিল কমায় এখন যে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় হচ্ছে, তা দিয়েই দায় শোধ করা যাচ্ছে। তবে আগে খোলা ঋণপত্র, বেসরকারি ও সরকারি খাতের ঋণের দায় শোধের কারণে সংকট কাটছে না।
‘আমরা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছি না। ফলে, কৃষিযন্ত্র আমদানি করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব ঋণপত্র খোলা গেছে, এর কয়েকটি ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারে দিতে হয়েছে ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। অথচ আমদানিতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১০৭ টাকার মধ্যে।’সাদিদ জামিল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেটাল প্রাইভেট লিমিটেড
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সব ক্ষেত্রে ডলারের দাম এক করার পরামর্শ দিয়েছে। এর ফলে ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে। ডলারের সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। ফলে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১১৬ কোটি ডলার। এক বছর আগে যা ছিল ৪ হাজার ৪২৬ কোটি ডলার। রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলার বিক্রি করছে ১০৩ টাকা দরে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে রাখা যেতে পারে। এতে মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে না। অন্য ক্ষেত্রে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটতে পারে। এতে ডলারে আয় বাড়বে। তবে ডলারের দামের যে ব্যবধান, তা-ও কমিয়ে আনতে হবে।