চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশে ৬৮৮ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে। এই অর্থের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় এসেছে ঢাকা জেলায়, ২৩০ কোটি ১০ লাখ ডলার। আর সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে লালমনিরহাটে, মাত্র ৫৬ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ জেলাভিত্তিক প্রবাসী আয়ের তথ্য থেকে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোয় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ সবচেয়ে বেশি। আর রংপুর বিভাগে তা সবচেয়ে কম।
গত মাসে, অর্থাৎ নভেম্বরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সব মিলিয়ে ১৯৩ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। তবে এই মাসে কোন জেলায় কত প্রবাসী আয় এসেছে, তার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো প্রকাশ করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত অক্টোবর মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, যা ছিল আগের চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত জুলাই মাসের তুলনায় আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় আসার পরিমাণ কমে গিয়েছিল। পরে অক্টোবরে আবার তা বৃদ্ধি পায়।
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও প্রতি ডলারে এখন সমপরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে প্রবাসীরা বৈধ পথে পাঠানো প্রতি ডলারের জন্য ১১৫ টাকার বেশি দাম পাচ্ছেন। কোনো কোনো ব্যাংক অবশ্য আরও বেশি দাম দেয়। অতিরিক্ত প্রণোদনার কারণে গত মাসে বেড়েছে প্রবাসী আয়। আগের বছরের নভেম্বরের তুলনায় গত নভেম্বরে প্রবাসী আয়ে ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে ঢাকা জেলায়। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার অবস্থান। গত চার মাসে ঢাকা জেলায় ২৩০ কোটি ১০ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম জেলায় ৫৮ কোটি ৮৮ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। এ ছাড়া সিলেটে ৪০ কোটি ৫১ লাখ, কুমিল্লায় ৩৮ কোটি ৭০ লাখ ও নোয়াখালী জেলায় ২২ কোটি ৪৯ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে।
সব মিলিয়ে জুলাই–অক্টোবর সময়ে মোট প্রবাসী আয়ের ৫৭ শতাংশই এসেছে শীর্ষ এই পাঁচ জেলায়। শীর্ষ দশে থাকা অন্য জেলাগুলো হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চাঁদপুর, মৌলভীবাজার ও নরসিংদী।
চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে লালমনিরহাট, রাঙামাটি, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও খাগড়াছড়ি—এই পাঁচ জেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে লালমনিরহাটে, মাত্র ৫৬ লাখ ডলার। অন্য জেলাগুলোর মধ্যে রাঙামাটিতে ৫৯ লাখ, ঠাকুরগাঁওয়ে ৬১ লাখ, পঞ্চগড়ে ৭১ লাখ ও খাগড়াছড়িতে ৭৬ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে।
এক কোটি ডলারের কম রেমিট্যান্স এসেছে, এমন আরও দুই জেলা হচ্ছে কুড়িগ্রাম (৯৫ লাখ ডলার) ও জয়পুরহাট (৯৬ লাখ ডলার)।
বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, প্রবাসী আয়ে শীর্ষ বিভাগ ঢাকা। এর মধ্যে শুধু ঢাকা জেলায় আসা প্রবাসী আয় অন্য যেকোনো বিভাগের সম্মিলিত প্রবাসী আয়ের তুলনায় বেশি। যেমন দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোর মোট প্রবাসী আয় ১৯২ কোটি ৬৫ লাখ ডলার, যেখানে এক ঢাকা জেলাতেই আয় এসেছে ২৩০ কোটি ডলারের বেশি।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, রাজধানী হওয়ার কারণে ঢাকা থেকে বিদেশে কাজ নিয়ে যাচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে ঢাকায় প্রবাসী আয় আসার পরিমাণও বেশি। তবে দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচার করে তা আবার প্রবাসী আয় হিসেবে ফিরিয়ে আনার কথাও শোনা যায়। ফলে এরও একটা প্রভাব থাকতে পারে ঢাকা জেলার প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে।
ঢাকা জেলায় এককভাবে বেশি প্রবাসী আয় এলেও ঢাকা বিভাগেরই অন্যান্য জেলায় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ তুলনামূলক কম। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগের বেশির ভাগ জেলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রবাসী আয় আসে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজার। চার মাসে এই চার জেলায় সম্মিলিতভাবে মাত্র ৭ কোটি ১৪ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে।
প্রবাসী আয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে রংপুর বিভাগের আট জেলা। গত জুলাই-অক্টোবর মাসে এই আট জেলায় সম্মিলিতভাবে ৮ কোটি ৩৫ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। রংপুরের পরে কম প্রবাসী আয় এসেছে ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোয়।
সাধারণত সামাজিক সম্পর্কের সূত্রে প্রবাসে যাওয়ার সুযোগ বেশি তৈরি হয়। ফলে যেসব এলাকা থেকে অনেকে বিদেশে রয়েছেন, সেখান থেকে কাজের জন্য প্রবাসে যাওয়ার হারও বেশি। তাই ওইসব এলাকায় প্রবাসী আয়ও বেশি আসে। তবে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলো থেকে অভিবাসন বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, প্রবাসী আয়ে পিছিয়ে থাকা প্রায় প্রতিটি জেলা জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অন্যতম কৌশল হিসেবে অভিবাসনকে দেখা হয়। ফলে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা এসব এলাকায় অভিবাসনে আগ্রহ বৃদ্ধি করতে তহবিল বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া ও ভিসাপ্রক্রিয়া সহজীকরণের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এতে এসব এলাকা থেকে অভিবাসন বাড়বে। কমবে দারিদ্র্য, বাড়বে প্রবাসী আয়।