বাংলাদেশ ব্যাংক সভায় বলেছে, কর ফাঁকি দিতে কম দাম দেখিয়ে পণ্য কেনা হচ্ছে, হুন্ডিতে অর্থ যাচ্ছে।
সভায় জানানো হয়, বেশি দামে কোনো ব্যাংক ডলার কিনলে আর জরিমানা নয়, কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হবে।
নির্বাচনের আগে নানা গুজব আসবে। এসব গুজবে ব্যাংকারদের কান না দিতে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মানুষের হাতে এখন নগদ টাকা অনেক বেড়ে গেছে। এসব টাকা ব্যাংক থেকে তুলে হাতে রেখে দিয়েছেন গ্রাহকেরা। ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে এটা কোনো স্বাভাবিক চিত্র নয়।
তাই আমানতকারীরা যাতে আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে না নেন এবং হাতে থাকা বাড়তি টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যাংকারদের নির্দেশনা দিয়েছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলনকক্ষে গতকাল বুধবার বিকেলে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় তিনি এই নির্দেশনা দেন। সভায় উপস্থিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ও বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকদের পাশাপাশি সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা (এমডি) উপস্থিত ছিলেন। প্রতি তিন মাস পর এই ব্যাংকার্স সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ব্যাংক খাতের সমসাময়িক নানা বিষয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে আলোচনা হয়।
আতঙ্কিত হয়ে যাতে গ্রাহকেরা টাকা তুলে না নেন, সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ ব্যাংকারদের।
সভা শেষে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘সভায় অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সব বিষয় বলা যাবে না। ব্যাংক খাতে আস্থা বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কারণ, মানুষের হাতে নগদ অর্থ বেড়ে গেছে। এটা ব্যাংকে ফেরত আনতে হবে। একদিকে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে, এমন সময়ে মানুষের হাতে নগদ অর্থ বাড়তে পারে না।’
সেলিম আর এফ হোসেন আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, সরকারকে ঋণ দেওয়া কমানো হয়েছে। ব্যাংক খাতে তারল্য কমে গেছে। তবে খুব কমে যায়নি। কিছু ব্যাংক সমস্যায় আছে। গ্রাহক ঋণ চেয়ে পাচ্ছেন না, এমন পরিস্থিতি হয়নি। প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বা সেবা কেনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কম দামে পণ্য কেনা বন্ধ করতে হবে। তাহলেই হুন্ডি বন্ধ হয়ে যাবে।
সভায় অংশগ্রহণকারী একাধিক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০২২ সালের মে মাসে মানুষের হাতে নগদ টাকা ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। গত মে মাসে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।
সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে মানুষের হাতে প্রায় ১৪ শতাংশ নগদ অর্থ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রাও (ব্রড মানি) এক বছরে ১৭ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের মে মাসে ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা, গত মে মাসে তা কমে হয়েছে ১ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা।
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচনের বছর চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয়। তাই ব্যাংকারদের কোনো ধরনের গুজবে কান দেওয়ার দরকার নেই। রাজনীতিবিদেরা তাঁদের কাজ করবেন, ব্যাংকারদের পেশাদারির সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা করতে হবে। কারণ, ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেলে বড় সমস্যা দেখা দেবে।
সভায় কৃষিভিত্তিক প্রকল্প ও পুনঃ অর্থায়ননির্ভর প্রকল্পে ঋণ বাড়াতেও ব্যাংকারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সভায় বেশির ভাগ নির্দেশনা দেন গভর্নর। এ সময় তিনি জানান, ব্যাংকের সব তথ্য প্রকাশ করা হবে।
সভায় ব্যাংকারদের জানানো হয়, যারা ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কিনছে, তাদের বিষয়ে পরিদর্শন চলছে। কিছু ব্যাংক এটা করছে, তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এতে পুরো খাতে চাপ তৈরি হচ্ছে। যারা এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত, ধরা পড়লে আগের মতো আর জরিমানা করা হবে না। সরাসরি অপসারণ করা হবে।
এর আগে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনায় বেশ কিছু ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছিল। পাশাপাশি এই খাত থেকে কয়েকটি ব্যাংকের অর্জিত মুনাফা সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে (সিএসআর) খরচ করতে হয়েছে।
১ আগস্ট থেকে রপ্তানি আয়ে ডলারের বিনিময় হার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ও প্রবাসী আয়ে ১০৯ টাকা। এ ছাড়া আন্তব্যাংক লেনদেন ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি এই দাম নির্ধারণ করে আসছে।
গতকালের সভায় উপস্থিত তিনজন ব্যাংকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর কারণেই টাকা ও ডলারের সংকট দূর হচ্ছে না। তাদের বিষয়ে সভায় কোনো আলোচনা হয়নি।
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে আসছে। আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমানোই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।
সভায় আরও বলা হয়, অনেকে বলছেন, ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিল পরিশোধ বাকি আছে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি উভয় খাত মিলিয়ে বকেয়া বিল রয়েছে সাড়ে ৩ বিলিয়ন বা সাড়ে তিন শ কোটি ডলার।
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আগে দাম বেশি দেখিয়ে পণ্য আমদানি করা হচ্ছিল। নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সেটা এখন প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। এখন দাম কম দেখিয়ে পণ্য আমদানি হচ্ছে। ১ ডলারের পণ্য আমদানিতে ৩০ সেন্ট পাঠানো হচ্ছে। বাকি অর্থ পাঠানো হচ্ছে হুন্ডিতে। ফলে হুন্ডি কমছে না। এর সঙ্গে অর্থ পাচারের বিষয়টি জড়িত। এই প্রবণতা কমাতে ব্যাংকারদের উদ্যোগ নিতে হবে। এটাই এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম লক্ষ্য।
এ সময় একজন এমডি সভায় বলেন, ‘রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের আগে কোন পণ্য কোথায় রপ্তানি করা হচ্ছে, সে বিষয়ে ইএক্সপি ফরমের মাধ্যমে ঘোষণা দিতে হয় রপ্তানিকারকদের। তবে অনেক প্রভাবশালী রপ্তানিকারক তা পূরণ করছেন না। আমরাও তাঁদের কিছু বলতে পারছি না।’ এ সময় গভর্নর বলেন, ‘আমার কাছে প্রভাবশালী বলে কিছু নেই। সবকিছু আইন অনুযায়ী চলবে।’
সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, আর্থিক হিসাব ঠিক করা এখন অন্যতম লক্ষ্য। আমদানি-রপ্তানি তথ্য সময়মতো জমার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সভায়। খেলাপি ঋণ কমানো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কম দামে পণ্য কেনার ঘটনা এখনো ঘটছে। কর ফাঁকি দিতে এটা হচ্ছে, বাকি অর্থ হুন্ডিতে যাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে ব্যাংকগুলোকে কঠোর তদারকি করতে বলা হয়েছে।