ন্যাশনাল ব্যাংক
ন্যাশনাল ব্যাংক

পর্যবেক্ষক বসানোর নয় বছর পর ভাঙা হলো ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ

ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন, আর্থিক অবস্থার অবনতি, ঋণে নানা ধরনের অনিয়ম এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) হঠাৎ পদত্যাগের প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের ৪ অক্টোবর ন্যাশনাল ব্যাংকের (এনবিএল) পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ৯ বছর ধরে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক থাকলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি।

ব্যাংকটির মালিকানায় থাকা সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধেই এত দিন অনিয়মের নানা অভিযোগ ছিল। শেষ পর্যন্ত সিকদার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার পর ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে দেওয়া ক্ষমতা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গতকাল বৃহস্পতিবার এক আদেশে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছেন। এর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমস্যাজর্জরিত ব্যাংকটির জন্য সাত সদস্যবিশিষ্ট নতুন পর্ষদ গঠন করেছে। নতুন পর্ষদে কারা থাকছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আলাদা চিঠি দিয়ে তা–ও জানিয়ে দিয়েছে। এর আগে ২০০৩ সালে বেসরকারি খাতের আরেকটি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক উদ্ধারে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। 

তবে দীর্ঘ সময় ধরে চলা অনিয়ম কেন ৯ বছর ধরে প্রশ্রয় দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আর্থিক খাতবিশেষজ্ঞরা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকটিতে রাখা মানুষের সব জমানো টাকা শেষ করে ফেলার পর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিলম্বে হলেও সিদ্ধান্তটি ভালো হয়েছে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এই ক্ষমতা সব সময় ছিল, কিন্তু তারা সময়মতো এটা প্রয়োগ করেনি। সময়মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ব্যয় বহন করা হয় জনগণের টাকা দিয়েই।’

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘এখন ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংকে একই কায়দায় লুট হচ্ছে, ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো টাকার জোগান দিয়ে ও সতর্ক করে দায় সারছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ব্যয়ও বহন করতে হবে জনগণকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময়মতো ব্যবস্থা নিলে ব্যাংক খাত ও সরকারের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ত। এতে ব্যর্থ হলে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। এখন তেমনটাই হয়েছে।’

গভর্নরের আদেশে যা আছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার আদেশ জারি করে গতকালই ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডির কাছে পাঠিয়েছেন। গভর্নরের পাঠানো চিঠিতে ব্যাংকটি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন।

গভর্নরের আদেশে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক ঋণের নিয়ম ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ অনুমোদন, পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ করা, পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকের শেয়ার একই পরিবারে কেন্দ্রীভূত করা, পরিচালক নির্বাচন বা পুনর্নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি, পর্ষদের গোচরে পরিচালকগণ কর্তৃক আর্থিক অনিয়ম সংঘটন, পর্ষদের নীতিনির্ধারণী দুর্বলতার কারণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি, ব্যাংকিং সুশাসন ও শৃঙ্খলা বিঘ্ন করার মাধ্যমে ব্যাংক-কোম্পানি ও আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে পর্ষদ কর্তৃক সম্পৃক্ত থাকার ঘটনা ঘটেছে।

এ জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সুপারিশে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও জনস্বার্থে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হলো বলে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের দেওয়া আদেশে বলা হয়েছে।

পর্ষদ বাতিলের এই আদেশ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানোর জন্য ব্যাংকটির এমডিকে নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর। জানতে চাইলে ব্যাংকটির এমডি মেহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পর্ষদ সদস্যদের বিষয়টি অবহিত করেছি। পাশাপাশি নতুন পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। আশা করছি প্রক্রিয়া শেষে তাঁরা দ্রুতই দায়িত্ব নেবেন। ব্যাংকটি শিগগির ঘুরে দাঁড়াবে, এই আশা করছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকটির পর্ষদের দায়িত্ব ছিল আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু তারা সেটি না করতে পারায় আগের পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে।

নতুন পর্ষদে যাঁরা

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকালই নতুন পর্ষদ গঠন করে ব্যাংকটির এমডিকে চিঠি দিয়েছে। এতে নতুন তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালকের পাশাপাশি চারজন শেয়ারধারী পরিচালককে রাখা হয়েছে। আগের পর্ষদের চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার এবং পরিচালক রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার, নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া ও মুরশিদ কুলি খান বাদ পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন শেয়ারধারী পরিচালক এবং বাকি দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন।

নতুন পরিচালনা পর্ষদে যাঁরা স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন। তাঁদের মধ্যে পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে। মেঘনা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের শর্তে তাঁকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

নতুন পর্ষদে শেয়ারধারী চার পরিচালক হলেন পারভীন হক সিকদার, উদ্যোক্তা পরিচালক খলিলুর রহমান, সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারী পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকটিকে রক্ষায় আমরা বুধবারই বৈঠক করে বর্তমান পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নিই। এরপর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। আমরা মনে করি, এতে ব্যাংকটির গ্রাহকের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থও রক্ষা হবে।’

পর্ষদ ভাঙার নেপথ্যে

পরিচালকদের দ্বন্দ্বের কারণে সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকে সম্প্রতি আবারও অস্থিরতা শুরু হয়। ব্যাংকের অন্যতম পরিচালক পারভীন হক সিকদার ‘প্রহসনমূলক ভোটে’ পরিচালক পদ থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা করেছিলেন। এ জন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) চিঠি দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে এজিএম অনুষ্ঠানের দাবি জানান।

পারভীন হক সিকদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটির ৪০তম বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজনের ওপর আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করেন চেম্বার আদালত। ওই দিন আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা। আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম গত মঙ্গলবার আদেশটি দেন। এই আদেশের ফলে গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংকটির এজিএম হয়নি।

ন্যাশনাল ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন পারভীন হক সিকদারের প্রয়াত পিতা জয়নুল হক সিকদার। পরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে আসেন। জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার ছিলেন ভেঙে দেওয়া পর্ষদের চেয়ারম্যান। রন হক সিকদার এবং রিক হক সিকদার তাঁর দুই ছেলে। উদ্যোক্তাদের কয়েকজনের ঋণ জালিয়াতির কারণে ব্যাংকটি এখন ধুঁকছে।

ব্যাংকটির বর্তমান এমডি মেহমুদ হোসেন পদত্যাগও করেছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপে তিনি আবার ব্যাংকে ফেরেন। ন্যাশনাল ব্যাংকে নানা অনিয়ম ও এমডির পদত্যাগের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। গত দেড় দশকে ব্যাংকটির বেশির ভাগ এমডিই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।

আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়

ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৩১ শতাংশ। এ ছাড়া অবলোপন করা খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। এর বাইরে ৭ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা নিয়মিত দেখানো হলেও এর বিপরীতে কোনো আয় নেই। সব মিলিয়ে ২২ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা বা ৫৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ ঋণের বিপরীতে কোনো আয় পাচ্ছে না ব্যাংকটি। এদিকে মোট ঋণের মধ্যে ২৪ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা বা ৫৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ রয়েছে শীর্ষ ৩০ গ্রাহকের কাছে, যাঁদের মধ্যে কাগুজে প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একক পরিবার, ব্যক্তি বা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান একটি ব্যাংকের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারে। তবে ব্যাংকটিতে সিকদার পরিবারের শেয়ার রয়েছে ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

প্রচলিত ধারার প্রতিটি ব্যাংককে মোট আমানতের ১৭ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে হয়। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক ১৪ মাস ধরে বিধিবদ্ধ তারল্য জমা রাখতে পারছে না। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৩০০ কোটি টাকা জরিমানা করলেও ব্যাংকটি তা পরিশোধ করতে পারেনি। টাকার সংকট মেটাতে এখন উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে ন্যাশনাল ব্যাংক।