রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের। তারপরও এ চার ব্যাংক সম্প্রতি সাত হাজারের বেশি ব্যাংকারকে পদোন্নতি দিয়েছে। এর আগে ব্যাংকগুলো অবশ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদনও নিয়েছে। এতে বিভাগের শীর্ষ পর্যায়েরও সমর্থন রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে যাঁরা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁরা খুশিতে ইতিমধ্যে মিষ্টি খাওয়ানোও প্রায় শেষ করেছেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে সহকর্মী–সহমর্মী, আত্মীয়–পরিজন ও বন্ধু–শুভানুধ্যায়ীদের এখন ফেসবুকে, ফোনে, ই–মেইলে অভিনন্দন জানানো ও শুভেচ্ছা বিনিময় চলছে। এ রকম অবস্থায় এসে চার ব্যাংকের কাছে ওই পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ১৫ জানুয়ারি চার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) আলাদা চিঠি পাঠিয়ে ২২ জানুয়ারির মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়েছে বিভাগটি। সোনালীসহ তিন ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাখ্যা দিলেও আরেকটি ব্যাংক তা করেনি, আবার সময়ও চায়নি।
যোগাযোগ করা হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব ব্যাংকের ব্যাখ্যা পাওয়ার পর আমরা বসব। তারপর কী করা যায়, চিন্তা করা হবে।’
চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলেছে, চার ব্যাংকের সাংগঠনিক কাঠামো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় জনবল নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণের নিয়ম রয়েছে। অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়ারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সব ব্যাংকের ব্যাখ্যা পাওয়ার পর আমরা বসব। তারপর কী করা যায়, চিন্তা করা হবে।— নাজমা মোবারেক, সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে ‘সুপারনিউমারারি পদ’ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ নেই, এ কথা জানিয়ে দুই বছর আগেই চার ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। চিঠিতে তা–ও উল্লেখ করা হয়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি বলতে বোঝানো হয় কর্মচারীর বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের সুবিধার্থে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তৈরি করা পদের বিপরীতে পদোন্নতি। সুপারনিউমারারি পদ তৈরির মাধ্যমে পদোন্নতিকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিও বলা হয়।
চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আরও বলেছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে যে পদোন্নতি দিয়েছে, তা প্রচলিত বিধিবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ পদোন্নতি দেওয়ার কারণে আর্থিক সংশ্লেষ কী হবে, তা উল্লেখসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পদোন্নতি দেওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বেতন-ভাতা ও পদমর্যাদা বেড়েছে। উপসচিব থেকে তার ওপরের পর্যায়ের সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে মাসিক ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে প্রায় একই ধরনের সুযোগ পাবেন পদোন্নতি পাওয়া এই ব্যক্তিরা।
সুপারনিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম), সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও), প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও), সিনিয়র অফিসার (এসও) ইত্যাদি পদে। এর মধ্যে এক হাজারজনের বেশি ব্যাংকার এসপিও থেকে এজিএম হয়েছেন। এজিএম হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহী পদের প্রথম ধাপ। এজিএমরা ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য যাঁর যাঁর ব্যাংক থেকে ৩০ লাখ টাকার সুদমুক্ত ঋণ পান। আর গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে পান ৪২ হাজার টাকা। ব্যক্তিগত কক্ষও বরাদ্দ থাকে তাঁদের জন্য।
ব্যাখ্যা দেওয়া তিনটির মধ্যে দুই ব্যাংকের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছে, ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পদোন্নতি–জটে আটকে ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তারা। তাঁরা অন্য ব্যাংকের তুলনায় পিছিয়ে ছিলেন। আবেদন করলে ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ৮৭৩তম পর্ষদ সভায় একই পদে ৫ বছরের বেশি সময় কর্মরত নির্বাহী কর্মকর্তাদের উচ্চতর পদে সুপারনিউমারারি হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ব্যাংকের সবাই উজ্জীবিত হন এবং শৃঙ্খলা ফিরে আসে।
সোনালী ব্যাংক জানায়, সুপারনিউমারারি পদোন্নতি পাওয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী ২ হাজার ১৬৯ জন হলেও দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৮৪২ জনকে। ভবিষ্যতে আরও পদোন্নতি দিতে হবে।
সোনালী ব্যাংক কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালায় ব্যাংকটিকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে বলেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যাখ্যায় জানানো হয়। বলা হয়, পিও থেকে এসপিও এবং এসপিও থেকে এজিএম হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের বেতন-ভাতায় কোনো আর্থিক সংশ্লেষ থাকবে না। পদোন্নতি পাওয়া এ ব্যাংকের সবার জন্য ব্যয় বাড়বে ২১ কোটি টাকার মতো, যা পরিচালন ব্যয়ের শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ।
এদিকে জনতা ব্যাংকের এমডি মো. মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের পর্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতি পেয়েছেন ৫৭৮ জন। মাসে তাঁদের জন্য ১৩ লাখ টাকার মতো খরচ হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে পদোন্নতি প্রাপ্ত এবং ভবিষ্যতে যাঁরা পদোন্নতি পাবেন, সবার জন্যই একটি যৌক্তিক জনবলকাঠামো তৈরির কাজ করছে চার ব্যাংক।