ইসলামী ব্যাংক থেকে কাগুজে কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ঘটনা প্রকাশের পর আবারও আলোচনায় এসেছে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি। আগে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তার আদায় ও বিচারের কতটা অগ্রগতি হয়েছে, বিষয়টিও সামনে আসছে। গত এক যুগের প্রধান ঘটনাগুলো তালিকা করলে প্রথমেই আসবে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা।
এরপরই বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ও প্রাইম ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের অনিয়ম, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ অনিয়ম। এ ছাড়া আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম, ইউনিয়ন ব্যাংকের বেনামি ঋণ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ঘটনা। আবার ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনা কয়েক বছর ধরেই আলোচনায়। এসব অনিয়মে ভূমিকা রেখেছে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে জোরপূর্বক কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা দখল।
২০১১ সালে হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (হোটেল শেরাটন) শাখা থেকে ঋণের নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়, যা নিয়ে তখন বড় আলোচনা তৈরি হয়। বাতিল করা হয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আটক করা হয় সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও হলমার্কের মালিককে। সেই ঘটনার বিচারকাজ এখনো চলছে। টাকাও আদায় করতে পারছে না সোনালী ব্যাংক।
২০১১-১২ সালে বেসিক ব্যাংকের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে প্রধান ভূমিকা রাখেন বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। এই টাকা থেকে ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় সেনানিবাসে দেড় বিঘা জমির ওপর একটি বাড়ি কিনেছিলেন তিনি। এত বড় বাড়ি কেনার অর্থ আবদুল হাইয়ের ব্যাংক হিসাবে কীভাবে এসেছিল, তারও বিবরণ বিএফআইইউ পাঠিয়েছিল দুদককে। তবে শেখ আবদুল হাইয়ের কিছুই হয়নি। ব্যাংকও বড় অংশ টাকা আদায় করতে পারেনি।
২০১২-১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
ঘটনা প্রকাশের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান, পরিচালক আনোয়ার চৌধুরী, নওরীন হাসিবসহ ঋণগ্রহীতারা। ওই কেলেঙ্কারির ঘটনায় ক্ষতিতে পড়ে জনতা, প্রাইম, যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক।
অ্যাননটেক্স গ্রুপের মালিক ইউনুস বাদল একাই। তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদারভাবে ঋণ দেয় জনতা ব্যাংক। এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে তারা দেয় ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। নিয়মনীতি না মেনে এভাবে ঋণ দেওয়ায় বিপদে ব্যাংক, গ্রাহকও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে পাওনা এখন সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি, যার বড় অংশই এখন খেলাপি।
ভুয়া রপ্তানি নথিপত্র তৈরি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। এভাবে সরকারের নগদ সহায়তা তহবিল থেকে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। অপকর্মে সহায়তা করার পাশাপাশি ক্রিসেন্ট গ্রুপকে অর্থায়নও করেছে জনতা ব্যাংক। ক্রিসেন্টের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। বিদেশে রপ্তানির ১ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। ফলে আটকে গেছে বড় অঙ্কের অর্থ। এ ঘটনায় কারও বিচার হয়নি।
অনুমোদন পাওয়ার পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ফারমার্স ব্যাংক। ফলে একসময় গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। সরকারের উদ্যোগে ব্যাংকটি বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ সংস্থা। এখন ঘুরে দাঁড়াতে নাম পরিবর্তন করে ফারমার্স ব্যাংক হয়েছে পদ্মা। তবে ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না।
ভল্ট কেলেঙ্কারির পর ঋণেরও বড় অনিয়ম হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে। শুধু ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে কোম্পানি গঠন করে ঋণের বড় অংশই বের করে নিয়েছে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না। কাগুজে এসব কোম্পানিকে দেওয়া ঋণের বেশির ভাগেরই খোঁজ মিলছে না এখন। ফলে এসব ঋণ আদায়ও হচ্ছে না। ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ৩৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ও বিতরণ করা ঋণ ছিল ৩১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।
কিন্তু ২০২১ সালভিত্তিক পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এসআইবিলের আরও ৫ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য। এতে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ২৩ শতাংশের বেশি।
পরিচালকদের মধ্যে কোন্দল, ক্রেডিট কার্ডে ডলার পাচার, বড় অঙ্কের সুদ মওকুফসহ নানা কারণে সংকটে ন্যাশনাল ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণও আটকে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংকটিকে উদ্ধারে সমন্বয়ক নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৭ সালে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় জোরপূর্বক পরিবর্তন হয়। এ সময় দুই ব্যাংকের এমডিদেরও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আর এসব পরিবর্তনে তড়িঘড়ি সম্মতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর থেকে ব্যাংক দুটিতে বড় অনিয়ম শুরু হয়।