ইসলামী ব্যাংক থেকে এক বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা

ইসলামী ব্যাংকের লোগো
ছবি: সংগৃহীত

গত বছর বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের আমানত ১৭ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা কমে গেছে। অর্থাৎ ২০২২ সালে এই পরিমাণ আমানত ব্যাংকটি থেকে তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা। ব্যাংকটির গত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ওই প্রতিবেদনের তথ্যে আরও দেখা গেছে, আমানত কমলেও গত বছরে ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে বা বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ব্যাংকটি। আমানত কমে যাওয়ার বিপরীতে ঋণ বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংকটি গত বছরে নগদ অর্থের সংকটে ছিল। প্রতিবেদনের তথ্যে পাওয়া গেছে, গত বছর শেষে ইসলামী ব্যাংকে শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ প্রায় ৫৬ টাকা ঋণাত্মক ছিল।

গত বছর ব্যাংকটিতে ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা প্রকাশ পায়। নামে-বেনামে সম্প্রতি খোলা হয়েছে এমন কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ব্যাংকটির চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদ, রাজশাহী শাখা, রাজশাহী নিউমার্কেট, পাবনা ও রাজধানীর গুলশান, গুলশান-২, ফার্মগেট, নবাবপুর রোড, বারিধারা শাখা থেকে এসব ঋণ দেওয়া হয়।

ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঋণ বিতরণে অনিয়মের ঘটনা প্রকাশ হলে ইসলামী ব্যাংকের আমানতকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এরই ফলাফল হিসেবে কমে যায় ব্যাংকটির আমানত। ফলে উচ্চ সুদে টাকা ধার ও আমানত নিতে হয় ব্যাংকটিকে।
ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে ও আমানতকারীদের আশ্বস্ত করতে অবশেষে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর পরিস্থিতির উন্নতি হয় বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

তবে বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক পরিদর্শন করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। আবার অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যাংকটিকে যেসব পরামর্শ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তা থেকেও পিছু হটে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

নগদ অর্থের সংকট

ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একদিকে যখন ইসলামী ব্যাংকে আমানত কমেছে, তখন বেড়েছে ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগ। ফলে তারল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গত বছর ব্যাংকটিকে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হয়।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর শেষে ব্যাংকটিতে শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ প্রায় ৫৬ টাকা ঋণাত্মক ছিল। অর্থাৎ বড় ধরনের নগদ অর্থের সংকট ছিল ব্যাংকটির। অথচ ২০২১ সালে ব্যাংকটিতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল। তখন ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ ছিল ৪১ টাকার বেশি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে এক বছরে কমেছে ৯৭ টাকার বেশি।

২০২১ সাল শেষে ইসলামী ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ও ঋণ ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা।

এরপরও বেড়েছে মুনাফা

আমানত কমে ঋণ বাড়লেও বিদায়ী বছরে ইসলামী ব্যাংকের নিট মুনাফা হয়েছে ৬১৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে এ ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৪৮০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির নিট মুনাফা বেড়েছে ২৮ দশমিক ২৮ শতাংশ।

এ প্রতিবেদনের আলোকে ২০২২ সালের জন্য শেয়ারধারীদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সুপারিশ করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। ঘোষিত লভ্যাংশ ও আলোচ্য হিসাব বছরের অন্যান্য বিষয়ে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে আগামী ২২ জুন ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আহ্বান করেছে ব্যাংকটি। এ-সংক্রান্ত রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে ২২ মে।

ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরে যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ঋণ বিতরণ করে ইসলামী ব্যাংক, যার মুনাফা যুক্ত হয়েছে ব্যাংকটির নিট আয়ে। তবে এর বিপরীতে যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি আমানত কমে গেছে ব্যাংকটির। এর ফলে আমানতকারীদের মুনাফাও কম দিতে হয়েছে। একদিকে ঋণ দিয়ে বেশি মুনাফা আয় ও আমানত কমে যাওয়ায় মুনাফা বাবদ খরচ কমে যাওয়ায় ব্যাংকটির আয় বেড়েছে।

তবে মালিকানা বদল হওয়া ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের অনেকগুলোর মান নিয়ে এর আগে প্রশ্ন তুলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২১ সালের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৬ থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই ১০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকটি। মালিকানা পরিবর্তনের আগে ২০১৫ সালে ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল ব্যাংকটি।

এবার নিট মুনাফা বাড়লেও শেয়ারধারীদের জন্য লভ্যাংশ কমিয়েছেন ব্যাংকটির পরিচালকেরা। সার্বিক বিষয় নিয়ে বক্তব্য জানতে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি।