ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে আইএমএফ। যদিও সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ২৫ শতাংশের বেশি।
নানা লক্ষ্য বেঁধে দিয়েও সরকারি ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এসব ব্যাংক বড় গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে আটকে গেছে। আবার অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে খেলাপি হওয়া ঋণকে সুযোগ দিয়ে নিয়মিত করা হলেও কিছুদিন পরই সেগুলোও আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। ফলে ঘুরেফিরে একই বৃত্তের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে সরকারি ব্যাংকগুলোর নানা সূচক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের একটি ছিল খেলাপি ঋণ কমানো। ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে সংস্থাটি। যদিও গত জুনে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণ ১০ দশমিক ১১ শতাংশে উঠেছে, মার্চে যা ছিল ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।
জুন মাসের হিসাবে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর গড় খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের কম। কিন্তু সরকারি খাতে তা ২৫ শতাংশ, মার্চে যা ছিল ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ব্যাংকের খেলাপি ঋণসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। তাহলেই এসব ব্যাংক শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরবে।মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক
আইএমএফের শর্তের কারণেই রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে আগামী বছরের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক চারটি হলো সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী। তবে কোন কৌশলে খেলাপি ঋণ কমাবে, তার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে সরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েছে।
গত মার্চে সোনালী ব্যাংকের ঋণের ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ খেলাপি ছিল, জুনে যা বেড়ে হয়েছে ১৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন এই চার ব্যাংকের মূলধনও ক্ষয় হয়ে গেছে। এখন বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে তারা।
পাশাপাশি বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।
এসব ব্যাংকে বিশেষ তদারকি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়কেরা ব্যাংকগুলোকে তদারকি করছে। এতে কোনো ফল মিলছে না।
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে এ নিয়ে বলেন,খেলাপি ঋণ কমাতে নতুন পরিকল্পনা করা হয়েছে। সামনের দিনে তা কমে আসবে।
নানা ধরনের ছাড় দিয়েও ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল-জুন সময়েই দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়।
সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা হয়েছে জনতা ব্যাংকের। তাদের খেলাপি ঋণ তিন মাসে ১৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা থেকে জুনে বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ—এই দুই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে নিয়ে সংকটে আছে ব্যাংকটি।
ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকেরা হলো ক্রিসেন্ট গ্রুপ, এর কর্ণধার এম এ কাদের ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আবদুল আজিজ। এরপর খেলাপির শীর্ষে রতনপুর গ্রুপ, এই গ্রুপের মালিক নোয়াখালীর মাকসুদুর রহমান, তিনি সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক পরিচালক। এরপরই চৌধুরী নিটওয়্যার ও চৌধুরী টাওয়েলের কর্ণধার বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বিসমিল্লাহ গ্রুপের মালিক খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী। খেলাপি অন্য গ্রাহকেরা হলো হাবিব হোটেল (হলিডে ইন), গ্রাম-বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার, এননটেক্স গ্রুপের এমএইচ গোল্ডেন জুট ও শাইনিছ নিট।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল জব্বার এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন,‘পুনঃ তফসিল করা কিছু ঋণ আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বড় কয়েকজন গ্রাহকের ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এসব ঋণ ইতিমধ্যে নিয়মিত করা হয়েছে। ফলে নতুন হিসাবে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।’
অগ্রণী ব্যাংকও একইভাবে বড় ও প্রভাবশালী বড় কয়েকজন গ্রাহককে ঋণ দিয়ে আটকে গেছে। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন মাসে ১৪ হাজার ৯৪৩ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকেরা হলো জাকিয়া গ্রুপ, তানাকা গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, সোনালী গ্রুপ ও মুন গ্রুপ। তাদের কাছে আটকা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি তিন মাসে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। খেলাপি গ্রাহকের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চট্টগ্রামের নুরজাহান গ্রুপ, বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এ এ নিট স্পিন লিমিটেড, ভার্গো মিডিয়া (চ্যানেল ৯) ও এইচআর স্পিনিং মিল। আরও খেলাপি গ্রাহকেরা হলো ইব্রাহিম কনসোর্টিয়াম, এস এ গ্রুপ, এম রহমান স্টিল, জাজ স্পিনিং, পান্না টেক্সটাইল, এইচজেড অ্যাগ্রো, হিমালয় পেপার অ্যান্ড বোর্ড, ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ও চৌধুরী লেদার।
সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৬ কোটি টাকা থেকে কিছুটা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকে আগে বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও নতুন করে এমন ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে না। ব্যাংকটি এখন বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোকে এড়িয়ে চলছে। ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেন ও ট্রেজারি ব্যবসা করে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় রয়েছে আলোচিত হল-মার্ক গ্রুপ।
নানা ধরনের ছাড় দিয়েও ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল-জুন সময়েই দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। এই খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াল। অর্থাৎ ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে যাঁরা পরিচালক আছেন, তাঁদের বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা।
তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি পেশাদার ব্যাংকারদের দিয়ে এসব ব্যাংক চালাতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। তাহলেই এসব ব্যাংক শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরবে। খেলাপি ঋণের দৌরাত্ম্য আটকাতে না পারলে আর্থিক খাতে দুশ্চিন্তা আরও বাড়বে।