ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো অস্থিরতা কাটেনি। কয়েকটি ব্যাংকের তারল্যসংকট প্রকট হওয়ার খবরে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বরং আরও খারাপ হয়েছে। কিছু ব্যাংক যখন গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়, তখন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত সরিয়ে নেন অনেক গ্রাহক। এ কারণে ওই সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণ কমাতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের আমানত ও ঋণ দুই-ই কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আমানত ও ঋণের চিত্র পর্যালোচনায় এই তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কিছুটা বেড়ে ৪৭ হাজার ৪৯১ কোটি টাকায় উঠেছিল। তবে চলতি বছরের মার্চে তা কিছুটা কমে হয় ৪৭ হাজার ৩০ কোটি টাকা। জুনে আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। এরপর গত সেপ্টেম্বরে আবার আমানত কমে। এবারে ৬৮ কোটি টাকা কমে ৪৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকায় নামে।
এদিকে গত বছরের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা, যা গত মার্চে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। গত জুনে ঋণ আরও বেড়ে ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা ওঠে। তবে সেপ্টেম্বরে ঋণ ৭৭৮ কোটি টাকা কমে ৭৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকায় নামে।
অবশ্য পাঁচ বছর ধরেই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধুঁকছে। বিশেষ করে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার যখন চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গিয়েছিলেন, তখন থেকেই সমস্যা প্রকট হতে থাকে। প্রতিষ্ঠান চারটি হলো পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ও এফএএস ফাইন্যান্স। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য আলোচিত হন পি কে হালদার।
পি কে হালদার যখন এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নেন, তখন তিনি ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা ফাইন্যান্স (সাবেক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স) ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আরেক আলোচিত এস আলমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দুটি এখনো ধুঁকছে। সে জন্য দুই প্রতিষ্ঠানেরই নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। পি কে হালদার এখন ভারতের জেলে আটক রয়েছেন। আর এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশছাড়া। তাঁর মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোও এখন ধুঁকছে।
জানতে চাইলে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়রা আজম প্রথম আলোকে বলেন, এখন আর্থিক খাত নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। অনেক ব্যাংক বড় সমস্যায় পড়েছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ভালো অবস্থায় নেই। কারণ, অনেক ভালো বড় করপোরেট গ্রুপ আগাম ঘোষণা ছাড়াই টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। সে জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া আগে থেকে পি কে হালদারের কারণে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে রয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করার সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের সুদের সীমা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিস্থিতি এমন হয় যে কিছু ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করে। ফলে ব্যবসা হারায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
এদিকে গত জুন মাসের শেষে আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের মোট ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। সে হিসাবে ৬ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।
দেশে ১৫টির বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে পি কে হালদার-সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হারই সর্বোচ্চ, ৯৯ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। তাঁর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ এ রকম—ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা; এফএএস ফিন্যান্স ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা এবং আভিভা ফিন্যান্স ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ বা ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকা।
এর বাইরে ফারইস্ট ফিন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা জিএসপি ফিন্যান্সের ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ফার্স্ট ফিন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, সিভিসি ফিন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফিন্যান্সের ৫৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, আইআইডিএফসির ৫৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, হজ ফিন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ফিনিক্স ফিন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ন্যাশনাল ফিন্যান্সের ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, বে লিজিংয়ের ৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ ও উত্তরা ফিন্যান্সের ৫০ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
দেশের প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো আইপিডিসি ফিন্যান্স, যেটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে। বর্তমানে দেশে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।