ডলার-সংকটের মধ্য দিয়েই চলতি বছরের শুরুটা হয়েছিল। বছরটা শেষ হয়ে এলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। অর্থাৎ সংকট কাটেনি। ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম বছরের শুরুতে ছিল ১০৩ টাকা, যা বেড়ে এখন হয়েছে ১১০ টাকা। ডলারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার সংকটও।
মাঝে আর্থিক সংকট মেটাতে ত্রাতা হয়ে আসা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ ব্যাংক খাতে সংস্কারের চাপ তৈরি করেছে। এতে সুদহারের ছয়-নয় নীতি থেকে সরে কিছুটা বাজারমুখী ব্যবস্থায় গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ডলারের দামও বাজারভিত্তিক করার চেষ্টা করছে।
নির্বাচনের পর ব্যাংক খাতের সংস্কার করে আর্থিক খাতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতেই হবে। ডলারের দাম ও সুদহার বাজারভিত্তিক করা এবং অনিয়মে জড়িত ইসলামি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াই হবে অন্যতম প্রধান কাজ। এতেই পুরো খাতে স্বস্তি ফিরে আসবে।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
বছরজুড়ে শরিয়াভিত্তিক ও প্রচলিত ধারার কিছু ব্যাংক ছিল লাগামছাড়া। শেষ সময়ে এসে অবশ্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অন্য ব্যাংকগুলোর বিষয়ে এখনো নির্বিকার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নতুন বছরে পুরো ব্যাংক খাত নিয়মের মধ্যে না ফিরলে বড় ঝুঁকি দেখছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ব্যাংক খাতকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের পর ব্যাংক খাতের সংস্কার করে আর্থিক খাতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতেই হবে। ডলারের দাম ও সুদহার বাজারভিত্তিক করা এবং অনিয়মে জড়িত ইসলামি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াই হবে অন্যতম প্রধান কাজ। এতেই পুরো খাতে স্বস্তি ফিরে আসবে। এখন দেখার বিষয়, আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা পদক্ষেপ নিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষা দেওয়া।’
২০২২ সালের মার্চে শুরু হওয়া ডলার-সংকট চলতি বছরেও পুরোপুরি দেখা গেছে। তবে চলতি বছরে আগের মতো ডলারের দাম ধরে না রেখে ধীরে ধীরে তা বাজারভিত্তিক করার দিকে নেওয়া হয়েছে। এতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা হলেও ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলার কিনছে ১২২-১২৩ টাকা দামে। ফলে এর চেয়ে বেশি দামে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে বছরজুড়েই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ধরে রাখা নিয়ে চাপে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, আইএমএফের ঋণের শর্ত ছিল, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে অন্তত ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের নেট রিজার্ভ থাকতে হবে। তবে তাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, সারা বছরই প্রতি মাসে গড়ে অন্তত এক বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তাতে নেট রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি আছে, তবে মোট রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন।
দ্রব্যমূল্যের উচ্চ দাম ও টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়ার কারণে সারা বছরই মূল্যস্ফীতি ছিল বাড়তি। এ জন্য চলতি বছরের মাঝামাঝিতে এসে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করা বাড়িয়ে দেয়।
এতে সরকারের টাকা ধারের সুদহার বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এদিকে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আমানতকারীরা সরকারি ট্রেজারিতে বিনিয়োগ করছে। ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ঋণে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৪ শতাংশে উঠেছে। এতে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে পড়েছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে।
গত জুলাই থেকে ব্যাংকঋণের সুদের হারের নতুন নিয়ম চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ কারণে ব্যাংকগুলোও এখন উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পারছে।
এদিকে সারা বছর শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকে তারল্যসংকট দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল। এসব ব্যাংকের আমানত বাড়লেও তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে জমা করেনি। বেনামি ঋণ ও ঋণ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য ব্যাংকে যে সমস্যা হয়েছে, তা সমাধানযোগ্য। তবে এসব ব্যাংকে যে ক্ষত হয়েছে, তার প্রভাব পড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনেও।
বছরজুড়ে খেলাপি ঋণ লাগামছাড়া ছিল। দেশের ব্যাংক খাতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
তাতে বোঝা যায়, গত ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ প্রায় ৭ গুণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে নানা লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হলেও তাতে তেমন সাড়া মিলছে না, বরং নতুন নতুন ঋণ খেলাপির ঝুঁকিতে পড়ছে।