রপ্তানি তথ্যে হিসাবের গরমিল থেকে বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই হিসাবের ক্ষেত্রে এনবিআরের তথ্যই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রপ্তানি কমে গেছে।
সদ্য বিদায়ী ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই সময়ে রপ্তানি ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলার কমেছে। এর ফলে দেশের আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে গেছে। তবে এতে নতুন করে ঘাটতিতে পড়েছে চলতি হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আজ বুধবার লেনদেনের ভারসাম্যের এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। এটা শুধু গণনার হিসাবে পরিবর্তন। এতে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে আছে।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃত রপ্তানি কত হচ্ছে, সেই তথ্য ব্যবহার করে আর্থিক হিসাব গণনা শুরু হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোও (ইপিবি) একই রকম রপ্তানি তথ্য ব্যবহার করবে। ফলে রপ্তানি তথ্য নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছিল, তা কেটে যাবে।
জানা গেছে, ইপিবির হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য। অন্যদিকে এনবিআর হিসাব কষে বলেছে, ওই সময়ে দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এনবিআরের এই হিসাবকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তিন সংস্থা মিলে গত দুই বছরের রপ্তানি হিসাব চূড়ান্ত করেছে। এতেও এনবিআরের হিসাবকে চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রপ্তানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, এটাই প্রকৃত। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি দেখিয়ে আসছিল ইপিবি।
বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস জুলাই-এপ্রিলে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার কমে যাওয়ায় রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার পার্থক্যও কমে এসেছে। এই সময়ে এ ক্ষেত্রে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৮ কোটি ডলার। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থে ২৪৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ফলে গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থেকে ২২৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।
বৈদেশিক আর্থিক সম্পদ ও দায় বিবেচনায় নিয়ে দেশের আর্থিক হিসাব গণনা করা হয়। এর মধ্যে থাকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ সম্পদ। বিনিয়োগের ধারা (সম্পদ ও দায়), বিনিয়োগের দলিল (ইক্যুইটি, বন্ড, নোটস এবং ঋণ) এই হিসাবের আওতায় আসে।
বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদের প্রথম বছরে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সব৴শেষ আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরের মার্চে ঘাটতি তৈরি হয়, যা গত মার্চ পর্যন্ত চলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি রপ্তানি ধরে হিসাব করা হতো। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এত পণ্য রপ্তানি হয়নি। ফলে আয় বেশি আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবই যৌক্তিক। সঠিক হিসাব না দেওয়ায় এত দিন নীতিনির্ধারকদের কাছে ভুল বার্তা গেছে। এতে করে পুরো খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ায় চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে চলে গেছে। ওই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য। এর বিপরীতে দেশে আমদানি হয়েছে মোট ৫ হাজার ২৩৭ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলার। সে সময় সেবা খাতে ঘাটতি ছিল ৩০৫ কোটি ডলার। আর প্রাথমিক আয়ে ঘাটতি হয়েছিল ৩৫৯ কোটি ডলার। তবে একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৯১১ কোটি ডলার। এতে সব মিলিয়ে ওই সময়ে চলতি হিসাবে ৫৭২ কোটি ডলার ঘাটতি তৈরি হয়।
মূলত রপ্তানি তথ্যের হিসাবে ওলট–পালট হওয়ায় বদলে গেছে দেশের লেনদেন ভারসাম্যের চিত্র। ফলে জুলাই-এপ্রিল সময়ের সার্বিক হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৫৫৬ কোটি ডলার।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন রপ্তানির ভুল তথ্য দেখিয়ে হিসাব করা হয়েছে। এটা আগেই ঠিক করে ফেলা উচিত ছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে, রপ্তানিকারকেরা কতটা ভালো করছেন। এর মাধ্যমে আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। এটা শুধু গণনার হিসাবে পরিবর্তন। এতে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে আছে।’