বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। ১০ শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ৫৫ শতাংশ ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী এসব গ্রাহক সময়মতো টাকা ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংকটির ৬১ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এ কারণে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকটি ১ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
সম্প্রতি সরকারের কাছে দেওয়া একটি চিঠিতে জনতার চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেছেন, জনতা ব্যাংকের ইতিহাসে এমন নাজুক অবস্থা আর কখনো হয়নি। ব্যাংকটি এখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সম্প্রতি এক সভায়ও নাজুক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা হয়।
ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় কী, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ব্যাংকটি। গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকটির বড় গ্রাহকদের অনেকেই কারাগারে, আত্মগোপনে বা দেশের বাইরে।
সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পেয়েছেন মজিবর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। খেলাপি ঋণ আদায়ে পথনকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। আমাদের গ্রাহকদের বেশির ভাগ বড় ব্যবসায়ী। তাই এসব ঋণ আদায়ে রাষ্ট্রের সহায়তা লাগবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।’
জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ১০ গ্রাহকের মধ্যে ৯ গ্রাহকই এখন খেলাপি। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ। গ্রুপটি জনতা ব্যাংক থেকে প্রথম ঋণ নেয় ১৯৭৮ সালে। এরপর দিনে দিনে ঋণ বেড়েছে। জনতার ঋণে একের পর এক নতুন কোম্পানি খুলেছে বেক্সিমকো গ্রুপ ও তার অন্যতম কর্ণধার সালমান এফ রহমান। কিন্তু ঋণ শোধ সেভাবে করেনি। বর্তমানে সালমান রহমান কারাগারে থাকায় ঋণ আদায় নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। খেলাপি ঋণ আদায়ে পথনকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। আমাদের গ্রাহকদের বেশির ভাগ বড় ব্যবসায়ী। তাই এসব ঋণ আদায়ে রাষ্ট্রের সহায়তা লাগবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।জনতার এমডি মজিবর রহমান
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগ্রাসী কায়দায় ব্যাংকটি থেকে ঋণ নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ। ২০২১ সালে জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ ছিল ১৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকায়। এই ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি। এখন ব্যাংকটি থেকে নতুন করে আবার ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার চেষ্টা করছে গ্রুপটি। অথচ হাজার কোটি টাকার বেশি রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আনছে না।
আদালতের আদেশে বেক্সিমকো গ্রুপে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক রুহুল আমিনকে রিসিভার নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। এখন সাবকন্ট্রাকে বা উপচুক্তিতে কাজ শুরু হয়েছে। ফলে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে না পারায় রপ্তানি আদেশ আসছে না। সামনে ব্যাংকে লেনদেন স্বাভাবিক হয়ে গেলে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা যাবে। তখন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করা হবে।
বেক্সিমকো ছাড়া ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকের মধ্যে আরও রয়েছে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। ব্যাংকটিতে এস আলম গ্রুপের ঋণ ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা খেলাপি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ঋণের বিপরীতে বন্ধক দেওয়া এস আলমের কিছু সম্পত্তি নিলামে তুলেছে ব্যাংকটি। তবে গ্রুপটি ঋণ নিয়মিত করতে জনতা ব্যাংকে খুব সামান্য টাকা জমা দিয়েছে।
জনতা ব্যাংকের আলোচিত আরেক গ্রাহক এননটেক্স গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ ৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। গ্রুপটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল। জনতা ব্যাংকে খেলাপি হওয়ার পরও এননটেক্সকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। তখন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম।
ব্যাংকটির আরেক গ্রাহক চামড়া খাতের আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপের খেলাপি ৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। গ্রুপটির কর্ণধার আবদুল কাদের ও তাঁর ভাই চলচ্চিত্র পরিচালক আবদুল আজিজ। আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে এ দুই গ্রুপের উত্থান হয় এবং ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ পায় তারা।
শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ আরেক শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরা ১৯৯৫ সালে জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করে। ২০২১ সাল পর্যন্ত জনতায় বসুন্ধরার ঋণ ছিল ৫০৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে যা বেড়ে হয় ২ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এসব ঋণের বেশির ভাগ খেলাপি।
২০২১ সালে জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ ছিল ১৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকায়। এই ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি। এখন ব্যাংকটি থেকে নতুন করে আবার ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার চেষ্টা করছে গ্রুপটি। অথচ হাজার কোটি টাকার বেশি রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আনছে না।
এ ছাড়া ব্যাংকটিতে থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। এই ঋণ খেলাপি হলেও আদালতের আদেশে তা খেলাপি হিসেবে নথিভুক্ত করতে পারছে না ব্যাংকটি। এ ছাড়া ব্যাংকটিতে আওয়ামী লীগের মেয়াদে ব্যবসা শুরু করা রানকা গ্রুপের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, রতনপুর গ্রুপের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা, শিকদার গ্রুপের ৮২৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। বড় গ্রাহকদের মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপের ঋণ নিয়মিত রয়েছে ব্যাংকটিতে।
এর বাইরে ব্যাংকটিতে আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল সালমান এফ রহমানের বিশেষ সুপারিশে।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান সম্প্রতি সরকারের কাছে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ‘অল্প কিছু গ্রাহকের কাছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু এসব ঋণ আদায় যথাযথভাবে হয়নি। এখন জনতা ব্যাংকের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বড় গ্রাহকদের ঋণ আদায়ের কোনো বিকল্প নেই।’
এদিকে, খেলাপি ঋণের বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির বড় খেলাপি গ্রাহকদের মধ্যে এননটেক্স, এস আলম গ্রুপ, ক্রিসেন্ট, থার্মেক্স গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি।
তবে বসুন্ধরা গ্রুপের আর্থিক বিভাগের প্রধান নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ নিয়মিত করতে অর্থ জমা দিয়েছি। ক্রেডিট কমিটি তা অনুমোদন করেছে। ব্যাংকের পরবর্তী পরিচালনা পর্ষদ সভায় তা অনুমোদন হলেই ঋণগুলো নিয়মিত হয়ে যাবে।’
এর বাইরে ব্যাংকটিতে আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল সালমান এফ রহমানের বিশেষ সুপারিশে।
জনতা ব্যাংক একসময় দেশের ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। ব্যাংকটির অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। সেই ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণে শীর্ষে। গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে ব্যাংকটিতে, যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে পর্ষদে থাকা পরিচালকেরাও।
ঋণ নিয়মিত করতে অর্থ জমা দিয়েছি। ক্রেডিট কমিটি তা অনুমোদন করেছে। ব্যাংকের পরবর্তী পরিচালনা পর্ষদ সভায় তা অনুমোদন হলেই ঋণগুলো নিয়মিত হয়ে যাবে।বসুন্ধরা গ্রুপের আর্থিক বিভাগের প্রধান নুরুল হুদা
গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়ায় ১ লাখ ১১ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা ও ঋণ ৯৮ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ৬০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬১ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫০৪ কোটি টাকায়। এসব খেলাপির বিপরীতে ৪৪ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারল্যসংকটে ব্যাংকটি মাত্র ৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা সঞ্চিতি রাখতে পেরেছে। ফলে গত সেপ্টেম্বরে জনতা ব্যাংকের মূলধনঘাটতি বেড়ে ৩৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হবে ৬৮ হাজার কোটি টাকা। তাতে বছর শেষে লোকসান বেড়ে দাঁড়াবে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকায়।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের এক স্মারকে বলা হয়েছে, ১ ডিসেম্বর জনতা ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাজুক পরিস্থিতি তুলে ধরলে গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করে ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষের টাকা ব্যাংকটিতে জমা ছিল, সেই টাকার নয়ছয় হয়েছে। যারা ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে, তাদের আইনের আওতায় এনে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকটিকে স্বাভাবিক ব্যবসা করে যেতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে বিশেষ জোর দিতে হবে।