দুর্নীতি, অনিয়ম আর অপরাধের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত কিংবা ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা অনেক প্রভাবশালী। কেউ কেউ অর্থ পাচার করেছেন বিদেশে। গণমাধ্যমে এসব খবর নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হলেও দেশের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ এদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অবশেষে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সক্রিয় হয়ে উঠেছে অর্থ পাচার প্রতিরোধে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
এখন প্রায় প্রতিদিনই এ সংস্থা সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে, আটকে দিচ্ছে ব্যাংকে থাকা লকার আর তলব করছে ব্যাংক লেনদেনের তথ্য। এসব হিসাবে হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত থাকার তথ্য মিলছে। এই হিসাবগুলো যাঁদের নামে, তাঁদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও পুলিশ কর্মকর্তাও। এসব ব্যাংক হিসাবে থাকা অর্থের উৎস ও আয়ের নথি খতিয়ে দেখছে বিএফআইইউ। পাশাপাশি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার (ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শুরু করেছে।
‘মাথায় পচন ধরলে কোনো সংস্থাই কাজ করতে পারে না, বিএফআইইউর ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে। সংস্থাটি সক্রিয় থাকলে অনেক আর্থিক অপরাধ ঘটত না বা রোধ করা যেত’আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, সাবেক প্রধান, বিএফআইইউ
দেশ ও বিদেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেও তা ঠেকাতে বা প্রতিরোধে গত ১৫ বছরে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংস্থাটি। এ অভিযোগে সরকার পতনের পর বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করে পদত্যাগে বাধ্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সে সময় তাঁর কক্ষ ও ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় অর্থ পাচারসংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের পদটি প্রায় এক মাস ধরে ফাঁকা থাকায় এটির কার্যক্রমও বিঘ্নিত হচ্ছে।
হঠাৎ সচল বিএফআইইউ
সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তা ও বাণিজ্যিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের পর ১১ আগস্ট বিএফআইইউ বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা শুরু করে। শুরুতে সাবেক মন্ত্রীদের হিসাব স্থগিত করে। পরে এ তালিকায় আসে আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, পুলিশ সদস্য ও সামরিক কর্মকর্তাদের নাম। স্থগিত হয়েছে সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি হিসাবও। সন্দেহভাজনদের পরিবারের সদস্যদের হিসাবও স্থগিত করা হয়েছে।
বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন সন্দেহভাজন, তাঁদের পরিবারের সদস্য ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ফলে এসব হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
সাবেক মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে হাছান মাহমুদ, মোহাম্মদ এ আরাফাত, জুনাইদ আহ্মেদ পলক, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক, মির্জা আজম, নসরুল হামিদ, আ হ ম মুস্তফা কামাল, ওবায়দুল কাদের, মহিবুল হাসান চৌধুরী, টিপু মুনশি, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নাজমুল হাসান পাপন, আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব বড়ুয়া, শেখ সেলিম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিআইজি মোজাম্মেল হকের হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।
এ ছাড়া সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এবং সেনাবাহিনীর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে হিসাব স্থগিত করা হয়েছে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যাংক হিসাব।
জানা গেছে, সরকার পরিবর্তনের পর গত ৮ আগস্ট সব ব্যাংকের প্রধান অর্থ পাচার প্রতিরোধ কর্মকর্তাদের ডেকে বিএফআইইউ জানায়, প্রভাবশালী হওয়ার কারণে এত দিন যাঁদের আর্থিক লেনদেন তদারক করা সম্ভব হয়নি, তাঁদের লেনদেন কঠোরভাবে তদারক করতে হবে। প্রভাবশালীদের লেনদেন সন্দেহজনক মনে হলে তাৎক্ষণিকভাবে সংস্থাটিকে তা জানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। এ ছাড়া সাবেক একজন সংসদ সদস্যের হিসাবে ২০ কোটি টাকা, পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হিসাবে ৬ কোটি টাকার তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। আবার দেশ-বিদেশ থেকে হাছান মাহমুদ, জুনাইদ আহ্মেদ পলক, মোহাম্মদ এ আরাফাতের সম্পদের বিষয়ে তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ। পাশাপাশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম, বেক্সিমকো ও নাসা গ্রুপের বিদেশে থাকা সম্পদের নথি পেয়েছে, যা নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি।
এত দিন কী করেছে ইউনিটটি
আইন অনুযায়ী, এটি স্বতন্ত্র একটি সংস্থা হিসেবে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করার কথা। তবে বিএফআইইউ কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, এটি শুধু আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে। এরপর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের অপরাধ প্রতিরোধকারী সংস্থা, যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তা পাঠিয়ে থাকে।
আইনে অর্থ পাচার বলতে শুধু বিদেশে অবৈধভাবে অর্থ পাঠানোকে বোঝায় না, দেশের মধ্যে অবৈধ অর্থের লেনদেনকেও বোঝানো হয়। সে কারণে ১০ লাখ টাকার বেশি অর্থ ও সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হয়। এর ভিত্তিতে পরিদর্শন প্রতিবেদন করে বিএফআইইউ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাই সংস্থাটি পরিচালনা করেন। ইউনিটপ্রধানও হন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরই এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তদাতা। যদিও ইউনিটের প্রধানকে কাগজপত্রে ক্ষমতা দেওয়া আছে।
আইনে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে জনবল নিয়ে বিএফআইইউ পরিচালনার সুযোগ থাকলেও সেই পথে হাঁটেনি এই ইউনিট।
বিএফআইইউ একসময় শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য নিতে পারত। এখন শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), বিমাপ্রতিষ্ঠান, জুয়েলারি দোকানসহ ১৭টি খাত থেকে তথ্য নিতে পারে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, দিনে দিনে এই ইউনিট অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। বিএফআইইউর প্রধান থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, এমন অভিযোগ ছিল। এ জন্য সরকার পরিবর্তনের পর অনেক কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিএফআইইউ এত দিন পরিচালিত হয়েছে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পরামর্শে। আবার যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁদের অনেকে সরকারের বিভিন্ন পদে ছিলেন এবং গভর্নরের সঙ্গে তাঁদের সখ্য ছিল। ফলে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল ইউনিটটি।
আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের তথাকথিত সেকেন্ড হোম তৈরি করা; সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে তারকা হোটেলের মালিকানা নেওয়া কিংবা সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা এখন বহুল আলোচিত বিষয়। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর অর্থ পাচারের অভিযোগ ব্যাংকপাড়ায় মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। কিন্তু এসব বিষয়ে বিএফআইইউর কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সরকারের পরিবর্তন হলেও সংস্থাটি নীরব ভূমিকায় রয়েছে।
বিএফআইইউর এ পরিস্থিতি কেন হয়েছে, জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাথায় পচন ধরলে কোনো সংস্থাই কাজ করতে পারে না, বিএফআইইউর ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে। আইনে বিএফআইইউকে কাজের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তবে পরিবেশ অনুকূলে না থাকা, ঝুঁকি না নেওয়া এবং ওপর থেকে বাধা আসায় এটি কাজ করতে পারেনি। বিএফআইইউ সক্রিয় থাকলে অনেক আর্থিক অপরাধ ঘটত না বা রোধ করা যেত।’