ব্যাংকটির হিসাবে, খেলাপি ঋণ ১,৬২০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকটির আরও ৫,৬৭৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিযোগ্য।
মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের পাঁচ বছরের মাথায় এসে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) ঋণে বড় অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এসআইবিএল নতুন যেসব ঋণ দিয়েছে, তার বেশ কটির ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। প্রকল্প ছাড়াই শুধু নথিপত্রের বিপরীতে অনেক গ্রাহককে টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব টাকা এখন ফেরত আসছে না। এ জন্য ব্যাংকটির সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ নতুন করে খেলাপি হওয়ার যোগ্য।
এসআইবিএলের হিসাবে, ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হিসাব করা হলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার দাঁড়াবে ২৩ শতাংশের বেশি।
১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করেছিল এসআইবিএল। তবে এর পরিচালকেরা ২০১০ সালের দিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকের পরিচালক হওয়া, ব্যাংক পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা, পরিচালকদের বেনামি ঋণসহ নানামুখী সংকট তৈরি হয়। এ অবস্থায় ২০১২ সালে তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান ব্যাংকটির পরিচালকদের ডেকে বিষয়গুলোর মীমাংসা করেন। এরপর ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু ২০১৭ সালের অক্টোবরে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আসে। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপ ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়। এর পর থেকে আবারও খারাপ হতে শুরু করেছে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা। তাতে আমানতকারীদের জমানো অর্থ ঝুঁকিতে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ নিয়ে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে যা ধরা পড়েছে, তার ভিত্তিতে এসআইবিএলকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটি যে পরিমাণ ঋণ খেলাপি দেখাচ্ছে, খেলাপিযোগ্য ঋণ তার চেয়ে আরও সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি। এসব ঋণ আদায় বা নিয়মিত করতে বলা হয়েছে, তা না হলে তার বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কথাও বলা হয়েছে।
এসআইবিএলের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ৩৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ও বিতরণ করা ঋণ ছিল ৩১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।
কিন্তু ২০২১ সালভিত্তিক পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এসআইবিলের আরও ৫ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য। তাতে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ২৩ শতাংশের বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ২৫ এপ্রিল এসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দিয়ে বলেছে, খেলাপি হিসেবে নতুন করে যেসব ঋণ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা গত জুনের মধ্যে, ১ হাজার কোটি টাকা সেপ্টেম্বরের মধ্যে ও বাকি অর্থ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়মিত করতে হবে। অন্যথায় এসব ঋণকে খেলাপি করতে হবে। খেলাপি হলে এ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। এসব ঋণের আদায় পরিস্থিতি প্রতি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়ার কথাও বলা হয় চিঠিতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে এসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম বলেন, ‘ঋণগুলো আদায়ের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে কিছু আদায়ও হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে।’
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এসআইবিএলের আমানত ছিল ২২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা গত বছর শেষে বেড়ে হয়েছে ৩৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণ ২১ হাজার ৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। তবে খেলাপি ঋণ ৮ দশমিক ২০ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।
আবার এসআইবিএল আমানতকারীদের অর্থ দুর্বল ব্যাংকে বিনিয়োগ করে রেখেছে। ফলে সময়মতো ফেরতও পাচ্ছে না। যেমন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে রাখা ১৮ কোটি টাকা দীর্ঘদিন ধরে ফেরত পাচ্ছে না। নতুন করে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে রাখা ১৮০ কোটি টাকা। আবার মালিকানা পরিবর্তনের পর আর্থিক খাতের আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও টাকা রেখেছিল এসআইবিএল, যা এখন আর ফেরত পাচ্ছে না। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে আছে ৩৫ কোটি টাকা, এফএএস ফাইন্যান্সে ৩০ কোটি টাকা, আভিভা ফাইন্যান্সে (সাবেক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স) ১৬৮ কোটি টাকা। এর বাইরে ইউনিয়ন ক্যাপিটালে রাখা ২০ কোটি টাকা, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে রাখা ১০ কোটি টাকাও আটকে গেছে।
বর্তমানে দেশজুড়ে এসআইবিএলের শাখা ১৭২টি। পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং ও উপশাখার মাধ্যমেও সেবা দিচ্ছে ব্যাংকটি।
মালিকানা পরিবর্তনের আগে ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে এসআইবিএলের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ঋণের ৭৩ শতাংশ ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে ২১ শতাংশ। সারা দেশে শাখা থাকলেও মাত্র ৬ শতাংশ ঋণ অন্য এলাকায় গেছে। যদিও আমানত এসেছে সারা দেশ থেকে।
মালিকানা পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়েছে নানা পক্ষ। আর ঋণ পরিশোধ করে চলে গেছেন কয়েকজন পুরোনো ভালো গ্রাহক। নতুন গ্রাহকদের অন্যতম ইনফিনিয়া স্পিনিং ও ইনফিনিয়া কম্পোজিটের ঋণের পরিমাণ ৮৯৬ কোটি টাকা। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসানুল আলম।
ঢাকার বেশ কয়েকজন গ্রাহকও যুক্ত করেছে ব্যাংকটি। এর মধ্যে অন্যতম ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকপক্ষ সিকদার গ্রুপ। গ্রুপটির পাওয়ার প্যাক–মুতিয়ারা পাওয়ার প্ল্যান্টসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ ৬৮০ কোটি টাকা। রংধনু বিল্ডার্স ও মেহেদি মার্টের ঋণ ৩৯৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এখন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি মাহবুব-উল আলম। তিনি চট্টগ্রামের হাসান আবাসন লিমিটেডের পক্ষে ব্যাংকটির পরিচালক। ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ, ইউনিটেক্স স্টিলের পক্ষে পরিচালক।