নয়–ছয় সুদহার থাকা না-থাকা নিয়ে বিতর্ক

মূল্যস্ফীতি নিয়ে চাপে প্রায় সব দেশ। মুদ্রা সরবরাহ কমাতে সুদহার বাড়ানোর ওপরই মূলত ভরসা। সুদের হারে পরিবর্তন আনতে চায় না বাংলাদেশ।

বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য ও ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে বেড়েছে খাদ্য, ভোগ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। যাতে চাপে পড়েছে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে চাপে আছে প্রায় সব দেশ। তারা মুদ্রা সরবরাহ কমাতে সুদহার বাড়ানোর ওপরই মূলত ভরসা করছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে সুদের হার কয়েক দফা বাড়িয়েছে। ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) বাড়াচ্ছে একটু ধীরগতিতে। বড় অর্থনীতির মধ্যে কেবল জাপানই শূন্য সুদের হার বজায় রেখেছে। আর ৮০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে পুরো বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে সুদের হার কমিয়েছে তুরস্ক।

সুদের হার যে কয়টি দেশ বাড়ায়নি, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশও। এখানে ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশই রেখে দেওয়া হয়েছে। আর এই সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির জনগোষ্ঠী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি, দামি ফ্ল্যাট, স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন বিলাসপণ্য কিনছেন। ঋণের সুদ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও দেদার ব্যাংকঋণ নিচ্ছেন। ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ যাচ্ছে, আমানত আসছে তার চেয়ে কম। ফলে দেশে মূলত মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদেরা সুদের হারের সীমা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করছেন।

তবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি সরবরাহজনিত বলে এর সুফল নিয়ে সন্দিহান বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য এখনো সুদহারে হাত দেওয়ার বিষয়ে নিমরাজি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তা ছাড়া অতীতে সুদহার নয়–ছয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে। ফলে সরকারের কাছে বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরার মতো উদ্যোগও কম বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে। তা ছাড়া সুদহার কম রাখাকে অনেকে ব্যবসায়ীদের তুষ্ট রাখার নীতি বলেও মনে করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ঋণের সুদহারের সীমা এখনই তুলে দিলে ঋণগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আরও বেশি চাপে পড়ে যেতে পারেন। এটি তাঁদের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে এবং যা ব্যবসার ব্যয়কে প্রভাবিত করতে পারে। যদিও ইতিমধ্যে ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা বিলাসপণ্য উৎপাদন ও আমদানি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ এবং গাড়ি, বাড়ি, ব্যক্তিগতসহ বিভিন্ন ভোক্তাঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি এবং এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন কাঁচামাল, জাহাজভাড়া ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। এ মুহূর্তে ঋণের সুদ বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। তবে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান ছাড়া অন্য খাতে সুদ বাড়ালে সমস্যা নেই। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে সতর্ক হতে হবে, খরচ কমাতে হবে। এমডিদের বেতনের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দিতে হবে।’

মূলত ব্যাংক চেয়ারম্যানদের উদ্যোগ ও সরকারি সিদ্ধান্তে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে মেয়াদি আমানতের সুদহার বেঁধে দেওয়া হয়। তবে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ হলেও ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ রয়ে গেছে। ফলে মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রেখে যা পাচ্ছে, তাতে বেড়ে যাওয়া খরচও মিটছে না। পুরো খরচ তো পরের বিষয়।

সুদহারের ৯ শতাংশ সীমা পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকঋণের বিদ্যমান সুদহার নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে (আরও বাড়িয়ে) রেখে বাজারভিত্তিক করে দেওয়া উচিত।’

ঋণ বাড়ছে বেশি

২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংকঋণের সুদহার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় আর করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছিল একই সময়ে। ওই সময়ে সব ধরনের ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। কেনাকাটাও ছিল কম। এ সময় আমানত বাড়ে। ব্যবসায়ীরাও নতুন বিনিয়োগ বন্ধ রাখেন। বরং কম সুদের ঋণ ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করে উদ্যোক্তাদের। আবার এই ঋণ নিয়ে অনেকেই অপব্যবহার করেন। ব্যাংকেরও মুনাফা বাড়ে, কারণ নতুন করে ঋণখেলাপি হওয়া স্থগিত রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তবে গত বছর থেকে করোনার প্রকোপ কমে এলে ঋণ নেওয়া বাড়তে থাকে। আমানতের সুদহার কমে এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের আগস্টে নির্দেশনা দেয়, ব্যক্তির মেয়াদি আমানতের সুদহার তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম হবে না। এরপরও ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে কমে যায়, এর বিপরীতে ঋণ বাড়ে বেশি। গত জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা আগের ৪৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

২০২১ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এই এক বছরে ঋণ বাড়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আর সুদহার বেঁধে রাখার সুযোগ নেই। ব্যাংকে আগের মতো উদ্বৃত্ত অর্থ নেই। কারণ, মানুষ সঞ্চয় কমাচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত ডলারও কিনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহ করতে হবে। এ জন্য ঋণের সুদহারও বাড়বে। না হলে অর্থনীতিতে অস্থিরতা আরও বাড়বে।’

সংকট কেন

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেড়েছে জাহাজভাড়াও। এতে অর্থবছরে আমদানি খরচ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। তবে সে তুলনায় রপ্তানি বাড়েনি, বরং কমেছে প্রবাসী আয়। এতে বেড়ে গেছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। তবে এর চেয়ে কমপক্ষে ৮ টাকা বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি দায় মেটাতে হচ্ছে আমদানিকারকদের।

ডলারের সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ফলে ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৬৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার চলে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভোল্টে। আর চলতি অর্থবছরে বিক্রি করেছে প্রায় ১৯০ কোটি ডলার। এতে গত জুলাই ও চলতি আগস্টে ব্যাংক থেকে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিল প্রতিনিয়ত কমে আসছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডলারের বাজারে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা স্বাভাবিক করতে সুদহারের সীমা তুলে দিতে হবে। এতে ঋণ কমবে। সুদহার বাড়লে অপ্রয়োজনে কেউ ঋণ নেবে না। এর ফলে আমদানির চাপও কমে আসবে।’