বেসিক ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া থেকে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রশ্ন উঠেছে বিপুল অর্থের সংস্থান নিয়েও।
সরকারি ও বেসরকারি পাঁচ ব্যাংক একীভূত করতে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এই অর্থ ব্যয় করতে হবে আগামী পাঁচ বছরে। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ কোথা থেকে আসবে, এ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূত হওয়ার যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা নিয়েও আপত্তি তুলেছে একাধিক ব্যাংক। আমানতকারীরাও আস্থা না রাখতে পেরে তুলে নিচ্ছেন আমানত। এতে কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে ব্যাংক একীভূতকরণ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হবে আংশিক। অর্থাৎ সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক আপাতত অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে না বলেই জানা গেছে।
একীভূত করা নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা হলেও গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পরামর্শ দেয়। এরপর গত ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৩ এপ্রিল সরকারি খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ৮ এপ্রিল সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে এবং ৯ এপ্রিল বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। একীভূত করার কোনো সিদ্ধান্তই স্বেচ্ছায় নেওয়া হয়নি, বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাধ্য করেছে।
একীভূত করার সিদ্ধান্তের পর থেকে এখন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। ফলে ব্যাংকটি নতুন করে তীব্র সংকটে পড়ে গেছে। তা ছাড়া আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না বলেও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে চিঠি দিয়েছে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাইয়ের সময়ে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের আত্মীয়স্বজন। তাঁরাও একীভূতকরণের প্রবল বিরোধিতা করছেন।
দুর্বল ব্যাংকের প্রভাবশালী মালিকেরা এখন একীভূত হতে আগ্রহী নন। কারণ, চলমান প্রক্রিয়ায় একীভূত হলে তাঁরা পার না–ও পেতে পারেন। যাঁরা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, যাঁদের কারণে ব্যাংকের এই পরিস্থিতি, সেসব বেরিয়ে আসবে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাও এখন ওই সব দুর্বল ব্যাংকের সম্পদের মান পর্যালোচনা করার কথা বলছে।বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন
অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংকও একীভূত হবে না বলে গতকাল সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে। একই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের আগের পরিচালনা পর্ষদকে বাতিল করে দেয় গত রোববার। একই দিনে নতুন পর্ষদ গঠন করা হলে তারাও একীভূত না হওয়ার কথা জানিয়েছে। এর পেছনে একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ভূমিকা আছে বলে সূত্র জানায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, দুর্বল ব্যাংকগুলোর মালিকপক্ষের পাশাপাশি সেই সব ব্যাংক থেকে বেনামে ঋণ নেওয়া প্রভাবশালী আরও একটি অংশ একীভূতকরণের বিরোধিতা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একীভূত করতে হলে আগে সম্পদ মূল্যায়ন করতে হবে। নিরীক্ষার সময় লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ যেমন বের হবে, তেমনি সন্ধান পাওয়া যাবে বেনামি ঋণেরও। এ কারণেও একীভূত করতে বাধা আসছে।
এর আগে বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে একীভূত করার প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সদস্যরাও বলে দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে একীভূত করছে, তাতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। যেসব ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া উচিত, তাদের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন।
একীভূতকরণের জন্য নির্মলা সীতারমণ ব্যাংকগুলোকে ৫৫ হাজার কোটি রুপি মূলধন সহায়তারও ঘোষণা দিয়েছিলেন।
একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। জোরপূর্বক ব্যাংক একীভূত করার সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে ভারত। দেশটির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট ১০টি সরকারি ব্যাংককে একীভূত করে চারটি বড় ব্যাংকে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই একীভূতকরণের জন্য নির্মলা সীতারমণ ব্যাংকগুলোকে ৫৫ হাজার কোটি রুপি মূলধন সহায়তারও ঘোষণা দিয়েছিলেন।
১৯৯৮ সালে পূর্ব এশিয়ার আর্থিক সংকটের পরে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জোরপূর্বক একীভূত করে ব্যাংক খাতকে লাভজনক করেছিল। সে সময় থাইল্যান্ড ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে ব্যয় করেছিল ৪৩০ কোটি ডলার, ইন্দোনেশিয়া ৪০০ কোটি ডলার এবং মালয়েশিয়া ১৩০ কোটি ডলার।
সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ মেনে যেসব ব্যাংক একীভূত করতে সম্মত হয়েছে, তাদেরও অর্থ দিতে হবে। একাধিক ব্যাংক মূলধন সহায়তা হিসেবে এরই মধ্যে অর্থের চাহিদার কথা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে দিয়েছে। অর্থের পরিমাণ চূড়ান্ত হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সব মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।
এই অর্থ কোন খাত থেকে দেওয়া হবে, সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অর্থ দেওয়ার মূল উৎস দুটি। যেমন রাজস্ব বাজেট থেকে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে, অথবা বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে দিতে হবে। বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে জনগণের করের টাকায় তা দিতে হবে। আর টাকা ছাপিয়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ আরও বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করা।
বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংককে বলা হয়েছিল বেসিক ব্যাংককে একীভূত করতে। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ হচ্ছে ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬২ দশমিক ৪ শতাংশ। এর বিপরীতে প্রভিশন বা সঞ্চিতি রাখা আছে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ অরক্ষিত অবস্থায় আছে ৬ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। এই অর্থ আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ব্যাংক একীভূত করেছে স্বীকৃত পন্থায়। তারা প্রায় সবাই আলাদা সম্পদ ব্যবস্থাপনা বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে তাদের কাছে ব্যাংকের খারাপ সম্পদ হস্তান্তর করেছে। এ ক্ষেত্রেও সেই সব কোম্পানিকে অর্থ দিতে হয়েছে। ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সুপারিশ থাকলেও বাংলাদেশে এখনো এ রকম কোনো কোম্পানি গঠন করেনি। ফলে সব খারাপ সম্পদের দায় নিতে হবে ভালো ব্যাংকটিকেই। সে ক্ষেত্রে অর্থ দিতে হবে ব্যাংককে।
বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংককে বলা হয়েছিল বেসিক ব্যাংককে একীভূত করতে। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ হচ্ছে ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬২ দশমিক ৪ শতাংশ। এর বিপরীতে প্রভিশন বা সঞ্চিতি রাখা আছে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ অরক্ষিত অবস্থায় আছে ৬ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। এই অর্থ আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনগত লোকসান হচ্ছে ৪০৭ কোটি টাকা। আর সামগ্রিকভাবে গুডউইল বা সুনাম সমন্বয়ের পরও ব্যাংকটির সম্পদের তুলনায় দায়ও অনেক বেশি বলে জানা গেছে। তাদের মূলধন ঘাটতির পরিমাণও ২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ অবস্থায় ব্যাংকটি পাঁচ বছরের মধ্যে ঠিক করতে ২৫ থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে প্রাথমিকভাবে হিসাব করা হয়েছে। এই অর্থ সরকারকেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি ৪৯৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে রাকাবের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ ৯৮২ কোটি টাকা। সুতরাং প্রতিটি ব্যাংকের স্থিতিপত্র বা ব্যালান্স শিট পরিষ্কার করতে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হবে।
একইভাবে ২০২৩ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসান ছিল ১ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। তাদের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা, এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ১১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা এবং মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি বেসিক ব্যাংকের চেয়ে খারাপ। সুতরাং ন্যাশনাল ব্যাংক ঠিক করতে প্রয়োজন হবে আরও অনেক বেশি অর্থ।
পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি ৪৯৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে রাকাবের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ ৯৮২ কোটি টাকা। সুতরাং প্রতিটি ব্যাংকের স্থিতিপত্র বা ব্যালান্স শিট পরিষ্কার করতে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই সুচিন্তিত প্রক্রিয়া মনে হয় না। অনেকটা অনানুষ্ঠানিক উপায়ে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথমে ঘোষণা এল, পরে নীতিমালা হলো। এখন যেভাবে একীভূত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, তা কোনোভাবে স্বপ্রণোদিত প্রক্রিয়া নয়। চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এতে ব্যাংক খাতে ভীতি তৈরি হয়েছে। আমানতকারীদের মধ্যে যেমন ভীতি তৈরি হয়েছে, কর্মীরাও ভীত হয়ে পড়েছেন।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, দুর্বল ব্যাংকের প্রভাবশালী মালিকেরা এখন একীভূত হতে আগ্রহী নন। কারণ, চলমান প্রক্রিয়ায় একীভূত হলে তাঁরা পার না–ও পেতে পারেন। যাঁরা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, যাঁদের কারণে ব্যাংকের এই পরিস্থিতি, সেসব বেরিয়ে আসবে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাও এখন ওই সব দুর্বল ব্যাংকের সম্পদের মান পর্যালোচনা করার কথা বলছে।
জাহিদ হোসেনের মতে, একীভূত করার মাধ্যমে যেসব ব্যাংককে সবল করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাদের সম্পদের চেয়ে দায়দেনা অনেক বেশি। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি যদি সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়, সরকারকে বাজেটের মাধ্যমে অর্থায়ন করতে হবে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক ওই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে অর্থায়ন করতে চাইলে টাকা ছাপিয়ে করতে হবে। দুটো ক্ষেত্রেই জনগণের ওপর চাপ পড়বে।