ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন

বেনামি ঋণ শোধ না করলে হবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি

জাতীয় সংসদে আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে বিল পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

ঋণ খেলাপি
প্রতীকী ছবি

ব্যাংক খাতে বেনামি ঋণ ও ঋণ জালিয়াতি এখন বহুল আলোচিত। এভাবে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলেই তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির এমন সংজ্ঞা নির্ধারণসহ বেশ কিছু পরিবর্তন এনে ব্যাংক কোম্পানি আইন আবার সংশোধন করা হচ্ছে। এতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশভ্রমণ ও পাঁচ বছর ব্যাংকে পরিচালক পদে বসার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল-২০২৩’ সংসদে উপস্থাপন করেন। এর আগে বিলটি সংসদে তুলতে আপত্তি জানান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। তিনি অভিযোগ করেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে এ সংশোধনী বিল আনা হয়েছে এবং সংসদে কোনো কিছু গোপন করা উচিত নয়।

তবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কারও পরামর্শে এ সংশোধনী আনা হচ্ছে না, হচ্ছে আধুনিক ও সময়োপযোগী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

‘ব্যাংক খাত যে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, দরকার ছিল আইন সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাপক সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া। বিলে যা আছে বলে জানতে পেরেছি, পুরো আশাবাদী হতে পারিনি। ইচ্ছাকৃত খেলাপি প্রমাণ করা কঠিন হবে। কোনো ব্যাংকের পরিচালক থাকলে যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিমা কোম্পানিরও পরিচালক থাকা যাবে না—এটা ভালো দিক।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

পরে কণ্ঠভোটে ফখরুল ইমামের আপত্তি নাকচ হলে বিলটি সংসদে তোলেন অর্থমন্ত্রী। সাত দিনের মধ্যে এ বিল পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

এর আগে গত মার্চে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের শর্ত মেনে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। গত ৩২ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে সাতবার। এর মধ্যে ব্যাংকমালিকদের চাপে এক পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে সর্বশেষ আইন সংশোধন করা হয় ২০১৮ সালে।

চিহ্নিত হবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি

বিলে প্রথমবারের মতো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা দেওয়াসহ তাঁদের সুবিধা কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কারা হবেন, সে বিষয়েও সুস্পষ্ট তালিকা দেওয়া হয়েছে। ঋণ শোধ করছেন না, এমন গ্রাহকদের মধ্যে যাঁরা সামর্থ্য থাকার পরও শোধ করবেন না এবং জালিয়াতি, মিথ্যা তথ্য ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ নেন, তাঁরা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এ ছাড়া এক উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়ে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে ও ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া জামানত হস্তান্তর করলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

বিলে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা আত্মীয় যে-ই হোক না কেন, তাঁদের সবাইকে জামানত দিয়ে ঋণ নিতে হবে। ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। আর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ইত্যাদি বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে সরকার।

বিলে আরও বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা না পাঠালে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন,‘ব্যাংক খাত যে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, দরকার ছিল আইন সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাপক সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া। বিলে যা আছে বলে জানতে পেরেছি, পুরো আশাবাদী হতে পারিনি। ইচ্ছাকৃত খেলাপি প্রমাণ করা কঠিন হবে। কোনো ব্যাংকের পরিচালক থাকলে যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিমা কোম্পানিরও পরিচালক থাকা যাবে না—এটা ভালো দিক।’

‘নতুন বিলে সবল ও দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার বিষয়ে বোঝা গেল যে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতেই এর এখতিয়ার থাকছে। আইনে আরও বিশদ ও পরিষ্কারভাবে থাকলে ভালো হতো। এরপরও আশা করব বাংলাদেশ ব্যাংক বিধি বা প্রজ্ঞাপন জারি করে এ বিষয়ে উদ্যোগী হবে। কারণ, সত্যিই দেশে দুর্বল স্থিতিপত্রের কোনো ব্যাংক থাকার দরকার নেই। এমনকি দুর্বল স্থিতিপত্রের বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থাকার দরকার নেই।’
আনিস এ খান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান

পরিচালক কারা ও কতজন হবেন

বিদ্যমান আইনে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে পরিচালক হতে পারেন ৪ জন এবং টানা ৯ বছর তাঁরা পর্ষদে থাকতে পারেন। সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজন পরিচালক হতে পারবেন।

৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার আগে আইএমএফের দল বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে এক পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তাতে কাজ হয়নি।

নতুন বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকে ন্যূনতম তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক থাকবেন। স্বতন্ত্র পরিচালক হবেন এমন ব্যক্তি, যার সঙ্গে ব্যাংক বা ব্যাংকের কোনো ব্যক্তির অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ স্বার্থের কোনো বিষয় জড়িত নেই।

বিকল্প পরিচালকের বিষয়ে নতুন ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, কোনো পরিচালক বিদেশে তিন মাস টানা অবস্থান করলে তাঁর অনুপস্থিতির কারণে পর্ষদ মূল পরিচালকের বিপরীতে বছরে সর্বোচ্চ একবার তিন মাসের জন্য বিকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে পারবে। এত দিন ব্যাংকে বিকল্প পরিচালক নিয়োগের বিধান ছিল না।

সাধারণ পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে এত দিন নিয়ম ছিল, কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক থাকলে, একই সময়ে তিনি অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। তবে দুই মেয়াদে বিমা কোম্পানির পরিচালক থাকতে পারবেন। নতুন বিলে বলা হয়েছে, এখন বিমা কোম্পানির পরিচালকও হতে পারবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো ব্যাংকের পরিচালক এবং পরিচালকের পরিবারের সদস্যদের বা কোনোভাবে তাঁদের নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠানের সুদ বা মুনাফা মওকুফ করা যাবে না।

একীভূত হওয়ার সুযোগ থাকছে

সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সুযোগের কথা বলা হয়েছে বিলে। তবে আইনে খসড়া যেভাবে করা হয়েছিল, তা থেকে অনেকটাই বদলে গেছে। খসড়ায় বলা হয়েছিল, কোনো ব্যাংক তার বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে মনে করলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করবে।

এর আগে একটি পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক দুই বছর সময় দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না দেখবে। পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে অবসায়নই হবে ব্যাংকটির অনিবার্য পরিণতি।

বিলে বলা হয়েছে, ব্যাংকের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আশু সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যাংকের কার্যাবলি এবং তার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক যদি পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় এবং আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ অব্যাহত রাখে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্যতামূলকভাবে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ বা পুনর্গঠন বিষয়ে এক বা একাধিক বিশেষ ব্যবস্থা নেবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন বিলে সবল ও দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার বিষয়ে বোঝা গেল যে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতেই এর এখতিয়ার থাকছে। আইনে আরও বিশদ ও পরিষ্কারভাবে থাকলে ভালো হতো। এরপরও আশা করব বাংলাদেশ ব্যাংক বিধি বা প্রজ্ঞাপন জারি করে এ বিষয়ে উদ্যোগী হবে। কারণ, সত্যিই দেশে দুর্বল স্থিতিপত্রের কোনো ব্যাংক থাকার দরকার নেই। এমনকি দুর্বল স্থিতিপত্রের বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থাকার দরকার নেই।’