বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক

পর্ষদ পুনর্গঠন করা সাত ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের তথ্য চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক 

তিন বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পরিকল্পনা কী, তা নিয়ে আজ শুরু হচ্ছে এসব ব্যাংকের সঙ্গে সভা। 

অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকাতে যেসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে, ওই ব্যাংকগুলোর কী পরিমাণ টাকা প্রভাবশালীদের কাছে আটকে রয়েছে, তা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি এসব ব্যাংকে যে তারল্য–সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণে কী পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে। এসব তথ্য নিয়ে আজ মঙ্গলবার পুনর্গঠন করা ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। প্রথম দফায় আজ ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের সাত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)। এর মধ্যে প্রথম ছয়টি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। তবে পর্ষদ পুনর্গঠন করে গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়েছে এসব ব্যাংক।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে আমরা ব্যাংকের সমস্যাগুলো তুলে ধরব। ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা চাইব। সহায়তা পেলে আশা করি, স্বল্পসময়ে আমরা পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যক্রম শুরু করতে পারব।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে আমরা ব্যাংকের সমস্যাগুলো তুলে ধরব। ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা চাইব।
আবদুল আউয়াল মিন্টু, চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ব্যাংক

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর নিরুদ্দেশ হয়ে যান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, যাঁরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেননি, তাঁদের ছাড় দেওয়া হবে না। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে।

২০ আগস্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ বিলুপ্তের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এখন পুনর্গঠিত পর্ষদের মাধ্যমে কীভাবে ব্যাংকগুলোর উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।

আজকের সভা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্তায় বলা হয়েছে, যেসব ঋণ আটকে আছে, তা আদায়ের পরিকল্পনা করতে হবে। এর মধ্যে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে কার কাছে কত টাকা আটকে আছে, এর সুনির্দিষ্ট তালিকা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দিতে হবে। যেসব ঋণ আদায়যোগ্য, তার বিপরীতে কী পরিমাণ জামানত বা বন্ধকী আছে, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে। আটকে পড়া অর্থ আদায়ে ব্যাংকের পরিকল্পনা কী, তা জানাতে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।

অন্যদিকে তারল্য–সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলো কী পদক্ষেপ নেবে, তা–ও জানাতে বলা হয়েছে। ঋণ আদায় করে ও আমানত বৃদ্ধি করে এটা সম্ভব নাকি অন্য কোন পন্থায় যেতে হবে, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবের ঘাটতি কত দিনে সমন্বয় হবে, নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) কত দিনে চাহিদামতো রাখতে পারবে, তা–ও জানতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া প্রবাসী আয় বাড়াতে ব্যাংকগুলো কী পদক্ষেপ নেবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে।

পুনর্গঠিত একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে লুটপাট হয়েছে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দিয়েছে। পর্ষদ পুনর্গঠন করায় এখন লুটপাট বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। টাকার সংকটে অনেক শাখা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

শীর্ষ গ্রাহক ও খেলাপি যারা

ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মাইশা গ্রুপের খেলাপি ঋণ স্থিতি ৩ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা, যার ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ আছে। বসুন্ধরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের
ঋণের স্থিতি ৩ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ ৩ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপের ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। এ ছাড়া চট্টগ্রামের মো. ইয়াসীন চৌধুরীর এফএমসি গ্রুপের ঋণ ১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, সাইফ পোর্ট হোল্ডিং ও সাইফ পাওয়ারটেকের ঋণ ১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা, ফু–ওয়াং ফুড ও এসএস স্টিলের ঋণ ৬৯৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন কর্ণফুলী গ্রুপের ঋণ ৬৭৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ব্যাংকটির খেলাপি গ্রাহকদের অনেকেই প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন।