মোট গ্রাহক ২১ লাখ ৫৮ হাজার
মাসে লেনদেন ২,৩১২ কোটি টাকা
ঋণের পরিমাণ ৮,২২৪ কোটি টাকা
ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের শীর্ষে দি সিটি ব্যাংক
অল্প কিছু টাকার জন্যও কারও মুখাপেক্ষী হওয়া কার ভালো লাগে। আবার স্বচ্ছন্দে কেনাকাটা করে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করতে পারলে আর্থিক চাপও কমে। মানুষের এমন অর্থায়নের চাহিদা মেটাচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। ফলে কেনাকাটায় কিংবা হঠাৎ টাকার প্রয়োজনে কারও কাছে না গেলেও চলে। এ ধরনের কার্ডে ব্যাংকের বুথ থেকে নগদ টাকা তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনাকাটা ও সেবার মূল্য পরিশোধ করা যায়। আর কোনো সুদ ছাড়া ৪৫ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধেরও সুযোগ মিলছে। এ কারণে দেশে দিনে দিনে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনও।
শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, বিদেশে গিয়েও ক্রেডিট কার্ডে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ রয়েছে। ফলে ক্রেডিট কার্ড এখন মানুষের পকেটে পকেটে। দেশে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক এখন ২১ লাখ। প্রতি মাসে লেনদেন হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
ক্রেডিট কার্ড সেবাকে জনপ্রিয় করতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দিচ্ছে নানা ছাড় ও সুবিধা। এর মধ্যে রয়েছে প্রথম বছর কোনো ধরনের মাশুল ছাড়া লেনদেনসুবিধা, নির্দিষ্টসংখ্যক লেনদেনে প্রতিবছর মাশুল মওকুফ, রিওয়ার্ড পয়েন্ট–সুবিধা, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য কেনাকাটায় ছাড়, হোটেলে থাকা ও খাওয়ায় নানা অফার। এ ছাড়া বিদেশ ভ্রমণে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগও রয়েছে। ফলে প্রতিবছর ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক হচ্ছেন প্রায় তিন লাখ মানুষ। তাঁদের ওয়ালেটে (মানিব্যাগ) এখন নগদ টাকার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে ক্রেডিট কার্ড।
বিশ্বের সব উন্নত দেশে ক্রেডিট কার্ড এখন বহুল প্রচলিত একটি আর্থিক পণ্য। নগদ টাকার বিকল্প হয়ে ওঠায় এটাকে প্লাস্টিক মানিও বলা হয়ে থাকে। প্রতি দেড় মাস পর নির্দিষ্ট দিনে খরচের টাকা পরিশোধ করলে কোনো সুদ দিতে হয় না। সে জন্য পৃথিবীজুড়ে দিন দিন ক্রেডিট কার্ড বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নগদ অর্থের লেনদেন কমে আসছে। কমছে অর্থ বহনের ঝুঁকিও।
বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের বড় অংশ এখনো রাজধানী ও বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক। ব্যাংকগুলো অবশ্য জেলা শহরগুলোতেও কার্ড ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে জেলা শহরে শুধু ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বাড়ালেই হবে না, তৈরি করতে হবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো।
ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ও ব্যবহার দুটিই বাড়ে যেকোনো উৎসবকে ঘিরে। ঈদকে সামনে রেখে এখন ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। গ্রাহক ও লেনদেন বাড়াতে এ সময়ে আমরাও নানা ধরনের অফার দিয়েছি।খুরশেদ আলম, রিটেইল ব্যবসা বিভাগের প্রধান, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একমাত্র কার্ডের ব্যবসা করছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির রিটেইল ব্যবসা বিভাগের প্রধান খুরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ও ব্যবহার দুটিই বাড়ে যেকোনো উৎসবকে ঘিরে। ঈদকে সামনে রেখে এখন ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। গ্রাহক ও লেনদেন বাড়াতে এ সময়ে আমরাও নানা ধরনের অফার দিয়েছি। তবে ঋণ পরিশোধের হার আগের চেয়ে কমে গেছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বেড়ে হয়েছেন ২১ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৬ জন। জানুয়ারিতে গ্রাহক ছিলেন ২১ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৩ জন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ছিলেন ১৮ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৪। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিলেন ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯২১ জন। ফলে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ নতুন গ্রাহক যুক্ত হচ্ছেন ক্রেডিট কার্ডে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। গত বছরের জানুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছরই লেনদেনও বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী,গত ডিসেম্বর শেষে গ্রাহকের সংখ্যা বিবেচনায় দেশে ক্রেডিট কার্ডের শীর্ষে ছিল বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক। ব্যাংকটির অ্যামেক্স কার্ড সেবার কারণে এ শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। তাদের গ্রাহকসংখ্যা ৩ লাখ ২০ হাজার ৩৪৮। এরপরই ব্র্যাক ব্যাংকের কার্ডের গ্রাহক ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪১৫, প্রাইম ব্যাংকের ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৮, বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের (এসসিবি) ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৬, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৮, ইস্টার্ণ ব্যাংকের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১ লাখ ৪ হাজার ৪৫৯, সাউথইস্ট ব্যাংকের ৮৮ হাজার ৩৭০, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮৮ হাজার ৩৩৫ ও ব্যাংক এশিয়া ৭৬ হাজার ৫০২ জন।
বর্তমানে দেশে ৪০টির মতো ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় সবাই ভিসা ও মাস্টারকার্ড ব্র্যান্ডের মাধ্যমে কার্ড সেবা দিচ্ছে। তবে এর বাইরে কয়েকটি ব্যাংক কার্ড সেবাকে অভিনবত্ব দিতে অন্য ব্র্যান্ডের কার্ডও এনেছে। সিটি ব্যাংক অ্যামেক্স কার্ড, প্রাইম ব্যাংক জেবিসি কার্ড, ইস্টার্ণ ব্যাংক ডিনার্স ক্লাব কার্ড, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক নেক্সাস পে কার্ড ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ইউনিয়ন পে ইন্টারন্যাশনালের সেবা দিচ্ছে।
গত ডিসেম্বর শেষে ক্রেডিট কার্ডে ঋণ ছিল ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮১৫ গ্রাহকের। আর পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ২২৪ কোটি টাকা।
হঠাৎ জরুরি প্রয়োজনে অর্থের সংস্থানের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক, আসবাব, পোশাক, গাড়ি, ভোগ্যপণ্যসহ অনেক পণ্য ও সেবা নিতে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা হয়। দামি পণ্যের ক্ষেত্রে রয়েছে কিস্তি সুবিধা। হাসপাতালের বিলও দেওয়া যাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে। তাই পকেটে অর্থ না থাকলেও সমস্যা নেই, একটি ক্রেডিট কার্ড থাকলেই সেখান থেকে নেওয়া যাচ্ছে ঋণসুবিধা।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রহমত উল্লাহ স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। মাঝেমধ্যে বেতন পেতেন একটু দেরিতে। সে জন্য বন্ধু-স্বজন বা সহকর্মীদের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হতো তাঁকে। একসময় পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে রহমত উল্লাহ ক্রেডিট কার্ড নেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড আমার কাছে অতিপ্রয়োজনীয়। বিপদে পড়লে যাতে রক্ষা পাই, সে জন্য এ কার্ডকে সঙ্গী করেছি। দুই বছর ধরে ক্রেডিট কার্ড আমার প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গী হয়ে গেছে। তবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হয় বিল পরিশোধে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ করা গেলে সুদও গুনতে হয় না। এতে ক্রেডিট কার্ডে নির্ভরতা বেড়ে গেছে।’
ব্যাংকাররা বলছেন, যাঁদের নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় আছে, তারা চাইলে এ কার্ড নিতে পারেন। এখন কারও মাসে ২০ হাজার আয় থাকলেই তাঁকে ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। কার্ড নিতে প্রয়োজন হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র, আয়ের সনদ, একজন জিম্মাদার ও বসবাসের ঠিকানার প্রমাণপত্র। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আবেদন পাওয়ার ২-৩ কর্মদিবসের মধ্যে ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্ড বিভাগের কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি চাকরিজীবীরা। এরপর সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষার্থীরাও ক্রেডিট কার্ডের বড় গ্রাহক।