চীনের বৃহত্তম ঋণদাতা তথা ব্যাংক ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) হ্যাকারদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। লকবিট নামে পরিচিত একটি হ্যাকার গোষ্ঠী আইসিবিসির যুক্তরাষ্ট্র ইউনিটে র্যানসমওয়্যার ভাইরাস হামলা করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। খবর দ্য ইকোনমিক টাইমস’র।
সম্পদের ভিত্তিতে আইসিবিসি শুধু চীনের বৃহত্তমই নয়, বরং বিশ্বেরও অন্যতম বৃহৎ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিতে র্যানসমওয়্যার হামলার কারণে মার্কিন ট্রেজারি মার্কেটের কার্যক্রমে ইতিমধ্যে বেশ কিছু ব্যাঘাত ঘটছে। ফলে বেশ কিছু আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করা যায়নি। এ জন্য ব্যবসায়ীদের বিকল্প উপায়ে লেনদেন সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন এমন একাধিক সূত্র হ্যাকিংয়ের খবরটি জানিয়েছে।
লকবিট মূলত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি অপরাধ সংঘটনকারী গোষ্ঠী। তারা মানুষের কম্পিউটারের বিভিন্ন ফাইলে প্রবেশে সক্ষম এবং ক্ষতিকর র্যানসমওয়্যার সফটওয়্যার বা ভাইরাস ব্যবহারে বেশ পারদর্শী। কারও কম্পিউটারে প্রবেশ, মানে হ্যাক করতে পারলে তারা ফাইলগুলো লক করে দেয়। তখন সেই সব ফাইল আনলক করার জন্য এই গোষ্ঠী মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করে বা হাতিয়ে নেয়।
এর আগেও বড় ধরনের সাইবার হামলা করেছে লকবিট হ্যাকার গোষ্ঠী। তারা উড়োজাহাজ নির্মাতা বোয়িং, ফিনটেক কোম্পানি আইওএন ট্রেডিং ও যুক্তরাজ্যের ডাক পরিষেবা কোম্পানি রয়েল মেইলেও আক্রমণ করেছিল।
বিশ্বব্যাপী বড় ব্যাংকগুলোর জন্য এটি একটি সত্যিকারের ধাক্কা। আইসিবিসির ঘটনার পরে এখন থেকেই বড় ব্যাংকগুলো তাদের সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে কাজ শুরু করবে।মার্কাস মারে, প্রতিষ্ঠাতা, সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ট্রুসেক, সুইডেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার আইসিবিসি তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে আক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তাতে ব্যাংকটি বলেছে, তাদের ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ইউনিটে একটি র্যানসমওয়্যার আক্রমণের ফলে কিছু সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটেছে। এ বিষয়ে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে আক্রমণের শিকার সিস্টেমগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ কাজে কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছে। তবে এই র্যানসমওয়্যার আক্রমণের কারণে আইসিবিসির প্রধান কার্যালয়, নিউইয়র্ক শাখা ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সিস্টেমগুলো প্রভাবিত হয়নি বলে জানিয়েছে ব্যাংকটি।
সাধারণত ক্রিপ্টো কারেন্সি বা মুদ্রায় লেনদেনে পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে হ্যাকাররা ক্রিপ্টো লেনদেন পছন্দ করে। কিন্তু চীনে ক্রিপ্টো মুদ্রা সম্পর্কিত লেনদেন নিষিদ্ধ। এ কারণে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে র্যানসমওয়্যার আক্রমণ সেভাবে দেখা যায় না। কিন্তু আইসিবিসির ক্ষেত্রে যেন কিছুটা ব্যতিক্রমই ঘটল।
সম্প্রতি উড়োজাহাজ নির্মাতা বোয়িংয়ের খুচরা যন্ত্রাংশ ও সফটওয়্যার পরিষেবা বিক্রির ওয়েবসাইট সাইবার হামলার শিকার হয়। লকবিটই হামলা করে। হ্যাকার গোষ্ঠী তখন ২ নভেম্বরের মধ্যে তাদের চাহিদামাফিক অর্থ না দিলে বোয়িংয়ের বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের হুমকি দেয়। যদিও পরে হ্যাকারদের নাম বোয়িংয়ের সাইট থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
এ ছাড়া জাপানের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর, যুক্তরাজ্যের রয়্যাল মেইল, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থ বিভাগ ও কানাডার একটি শিশু হাসপাতাল সাম্প্রতিক সময়ে লকবিটের হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন বা ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি করে হ্যাকাররা। এ ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছিল। বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক অপরাধগুলোর একটি মনে করা হয়।
২০১৬ সালের আলোচিত সেই ঘটনা নিয়ে তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সাল পিকচার্স হোম এন্টারটেইনমেন্ট। সেখানে ব্রিটিশ সাংবাদিক মিশা গ্লেনি বলেন, বিশ্ব ও মানবজাতির জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি চারটি—মহামারি, গণবিধ্বংসী অস্ত্র, জলবায়ু পরিবর্তন ও সাইবার হামলা।
এনডিটিভির এক খবরে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে র্যানসমওয়্যার হ্যাকারদের আক্রমণ রেকর্ড মাত্রায় হচ্ছে। এর মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করছে হ্যাকাররা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের র্যানসমওয়্যার পেমেন্ট রেকর্ড করেছে ব্লকচেইন বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান চেইন্যালাইসিস, যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। সাইবার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা কর্ভাস ইন্স্যুরেন্সের মতে, ২০২২ সালের প্রথম তিনটি ত্রৈমাসিকের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে র্যানসমওয়্যার আক্রমণ ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সর্বশেষ চীনের আইসিবিসি ব্যাংকের ঘটনাটি আর্থিক খাতে সাইবার ঝুঁকির বিষয়ে সম্ভাব্য বড় বিপদের দিকে আরেকবার আঙুল তুলল। বলা হচ্ছে, বড় কোনো সাইবার আক্রমণ বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য অংশকে বিকল করে দিতে পারে। যদিও আইসিবিসির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল বলে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা।
সুইডেনের সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ট্রুসেকের প্রতিষ্ঠাতা মার্কাস মারে বলেন, বিশ্বব্যাপী বড় ব্যাংকগুলোর জন্য এটি একটি সত্যিকারের ধাক্কা। আইসিবিসির ঘটনার পরে এখন থেকেই বড় ব্যাংকগুলো তাদের সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে কাজ শুরু করবে।