চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার।
ডলার কেনার কারণে বেশির ভাগ ব্যাংকের হাতে এখন টাকা নেই, সেই টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। তাই সরকারকেও চাহিদামতো ঋণ দিতে পারছে না বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মানে টাকা ছাপানো, বাজারে নতুন টাকা সরবরাহ করা। মাত্রাতিরিক্ত টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে সরকারের টাকা ধার নেওয়া এখনো লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক কী পরিমাণ টাকার জোগান দেয়, তা বোঝা যায় ‘রিজার্ভ মানি বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রার’ হিসাব থেকে। বাজারে যে অর্থপ্রবাহ রয়েছে, সেটিই রিজার্ভ মানি হিসেবে পরিচিত। গত মে মাস পর্যন্ত রিজার্ভ মানির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে যা ৩ লাখ ৮০ হাজার ১১ কোটি টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যে পরিমাণ টাকা গেছে, সরকার ঋণ নিয়েছে তার চেয়ে কম। কিন্তু ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেশি অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে আসায় বাজারে রিজার্ভ মানির প্রবাহ কমে গেছে।
বাজেট ঘাটতি পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের ১৮ দিনে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যদিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও টাকা ধার করেছে সরকার, যার পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ করার পাশাপাশি পুরোনো ঋণের অর্থও পরিশোধ করেছে সরকার। চলতি বছরের ১৮ দিনে ৭ হাজার ৪৪ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়েছিল ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। আর বাকি ঋণ নেয় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদানসহ চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার নেবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ও ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ জুলাই শেষে সরকারের মোট ব্যাংকঋণের স্থিতি ৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। গত ৩০ জুন এ ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৯৭ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি ১ লাখ ৫০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত ৩০ জুন এ স্থিতি ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন,‘সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেই। মাসওয়ারি এটা কম-বেশি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। বইয়ের ভাষা অনুযায়ী অনেকেই বলছেন যে এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়বে এবং তাতে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে। এখানে যে একটা অন্য চিত্রও আছে, তা আর কেউ বলছেন না।’
অন্য চিত্রটা কী—এমন প্রশ্নের জবাবে মেজবাউল হক বলেন, ‘প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে, বিপরীতে টাকা ঢুকছে ভল্টে।’
সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তিনভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়া মানেই টাকা ছাপানো বা রিজার্ভ মানি বৃদ্ধি। টাকা ধারের তিনটি উপায়ের একটি হচ্ছে ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স। অন্য দুটির আনুষ্ঠানিক নাম হচ্ছে ওভার ড্রাফট ও ডিভলভমেন্ট। এর মধ্যে ডিভলভমেন্ট অংশের ঋণের পরিমাণটাই সরকারকে টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়।
চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনে ‘ডিভলভমেন্ট’ ব্যবস্থার আওতায় সরকারকে ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স বাবদ সর্বোচ্চ সীমা ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া আছে সরকারের। আর ওভারড্রাফট বাবদ ঋণেরও সর্বোচ্চ সীমা ৮ হাজার কোটি টাকা। ১৮ জুলাই পর্যন্ত এ ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত সরকারের দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসাব কোনো কারণে না মিললে ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স এবং ওভারড্রাফটের মাধ্যমে তা মেটানো হয়। সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন একটা ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের হিসাবে ঘাটতি দেখা দিলে এ দুই উপায় ব্যবহারের মাধ্যমে ৮ হাজার করে মোট ১৬ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে সরকার। তবে সরকারের হিসাব উদ্বৃত্ত হলে আগের দেনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জুলাই মাসে সরকারের টাকা ধার নেওয়ার কারণ হলো, মে ও জুন মাসে ঠিকাদারদের ও বিভিন্ন খাতে সরকার যে টাকা ছাড় করে, তা জুলাই মাস পর্যন্ত উত্তোলন করা যায়। ফলে টাকা পরিশোধের জন্য সরকারকে টাকা ধার করতে হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, অর্থবছরের শুরুতে উন্নয়ন ব্যয় তত হয় না। তবে অন্য ব্যয় ঠিকই হয়। এ সময়ে কম হয় সরকারের আয়। তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার দরকার পড়তে পারে। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মিলিয়ে ঋণ নিলে তা ভারসাম্যপূর্ণ হয়।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে ডলার বিক্রি করছে, তা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আর টাকা থেকে যাচ্ছে দেশে। আমদানি ব্যয় মেটাতে আবার ডলার কম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যুক্তি টেকার মতো না। চলতি অর্থবছরে ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় কমিয়ে ফেলতে হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও ঋণ নেওয়ার পথে যেতে হবে সরকারকে।