মোবাইলে অর্থ উত্তোলন

১৮ টাকার সেবায় অনীহা

রাজধানীর মিরপুরের আফরোজা তাজিন ২০১৫ সাল থেকে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) বিকাশ ব্যবহার করছেন। আগে মার্কেটে কেনাকাটা করতে গেলে এজেন্ট থেকে টাকা তুলতেন। পরিষেবা বিল পরিশোধের আগে এজেন্ট থেকে টাকা তুলতেন, এরপর লাইনে দাঁড়াতেন। এক বছর ধরে আফরোজা তাজিন নগদ টাকা তোলেন না। অ্যাপস বা ইউএসএসডির মাধ্যমে কেনাকাটা ও পরিষেবা বিল পরিশোধ করছেন। এমনকি উবার বা পাঠাওয়ের বিলও এখন বিকাশে দেন।

আফরোজা তাজিন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি হাজারে সাড়ে ১৮ টাকা কাটলে বুকটা ধক করে উঠত। এখন সব টাকা পরিশোধ করি মুঠোফোনের মাধ্যমে।’
আফরোজা তাজিন একা নন, বিকাশ, রকেট, নগদ ও শিওরক্যাশের মতো সেবার ভোক্তারাও এভাবেই এমএফএসের উচ্চ মাশুলের জাল থেকে বের হয়ে আসছেন। এখন এমএফএস লেনদেনের মাত্র ৩০ শতাংশ টাকা নগদে উত্তোলন করা হচ্ছে। আর বাকি ৭০ শতাংশ লেনদেন হচ্ছে বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে। এসব সেবার বেশির ভাগই বিনা মূল্যে, কিছু ক্ষেত্রে প্রতি হাজারে সর্বোচ্চ ১০ টাকা গুনতে হয়। আর নগদ টাকা উত্তোলনে এখনো প্রতি হাজারে গুনতে হয় ১৮ টাকা ৫০ পয়সা।

তবে সেবা গ্রহণের বিকল্প মাধ্যম আসায় গ্রাহকদের ওপর উচ্চ মাশুলের চাপ কমেছে। এমএফএস সেবাদাতারা টাকা পাঠানো, বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, প্রবাসী আয় গ্রহণ, সরকারি বিল পরিশোধের মতো সেবা যুক্ত করায় ভোক্তারা উচ্চ মাশুল দিয়ে নগদ টাকা কম তুলছেন।

এ নিয়ে ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, এ সেবার বৈচিত্র্যকরণ হয়েছে। ফলে মানুষ উচ্চ মাশুলে টাকা উত্তোলন থেকে সরে এসেছে। এ সেবা আরও বৈচিত্র্যকরণের সুযোগ আছে, তা কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই মাশুল কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাইয়ে এসব সেবায় ৬২ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে নগদ টাকা উত্তোলন হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। আর আগস্টে ৪১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে নগদে উত্তোলিত হয় ১২ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ টাকা নগদে উত্তোলন করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় সেবাদাতা বিকাশের এজেন্ট থেকে নগদ উত্তোলনে প্রতি হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা গুনতে হচ্ছে। আর ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম থেকে ২ হাজার টাকা উত্তোলনে খরচ হচ্ছে ৩০ টাকা। এরপর প্রতি হাজারে ১৫ টাকা।

বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদির বলেন, ‘সবাই যখন ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা গ্রহণ করবে, তখন নগদ উত্তোলন আরও কমে আসবে। তখন মাশুলও কমবে। গ্রাহকদের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সেবা যুক্ত করছি। এসব সেবার বেশির ভাগের জন্য মাশুল লাগছে না বা তা কম মাশুলের।’

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের রকেট সেবায় এজেন্ট থেকে টাকা উত্তোলনে প্রতি হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হচ্ছে। তবে এ ব্যাংকের এটিএম থেকে উত্তোলনে খরচ হয় ৯ টাকা।

এখনো ৪০-৪৩ শতাংশ লেনদেন হচ্ছে নগদ অর্থ উত্তোলনে। এ জন্য গ্রাহকদের স্বস্তি দিতে আমরা খরচ কমিয়ে আনছি।’
নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ. মিশুক

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ‘আমিও টাকা উত্তোলনে এত মাশুলের পক্ষে নই। মাশুলের ৮০ শতাংশের বেশি এজেন্টরা নিয়ে যায়। তবে সবাইকে একযোগে কমাতে হবে, তাহলেই টেকসই হবে।’

এদিকে ডাক বিভাগের সেবা নগদের এজেন্ট থেকে টাকা উত্তোলনে প্রতি হাজারে অ্যাপসের মাধ্যমে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা এবং ইউএসএসডিতে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হচ্ছে। তবে অ্যাপসের মাধ্যমে ২ হাজার ১০০ টাকার বেশি তুললে প্রতি হাজারে ১১ টাকা ৪৯ পয়সা এবং ইউএসএসডিতে ১৪ টাকা ৯৪ পয়সা খরচ হচ্ছে।

নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ. মিশুক প্রথম আলাকে বলেন, ‘এখনো ৪০-৪৩ শতাংশ লেনদেন হচ্ছে নগদ অর্থ উত্তোলনে। এ জন্য গ্রাহকদের স্বস্তি দিতে আমরা খরচ কমিয়ে আনছি।’

গত আগস্টে এ সেবায় লেনদেনের মধ্যে ২৮ শতাংশ টাকা জমা হয়েছে। টাকা জমায় বিকাশ, রকেট ও নগদ কোনো মাশুল নেয় না। আবার একই সেবার অন্য গ্রাহককে টাকা পাঠাতে বিকাশ প্রতি লেনদেনে ৫ টাকা কাটলেও অন্যরা মাশুল নেয় না, এসব লেনদেন প্রায় ৩০ শতাংশ। আবার ৫ শতাংশ লেনদেন হয় কেনাকাটা ও বিল পরিশোধে। বেতন পরিশোধে প্রায় আড়াই শতাংশ লেনদেন হয়। মাশুল নেই।
এখন গ্রাহকেরা ঘরে বসে এমএফএস হিসাব খুলতে পারেন। রয়েছে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তরের সুবিধাও। বিভিন্ন পরিষেবা ও কেনাকাটার বিল পরিশোধ, মুঠোফোনে রিচার্জ, কাউকে টাকা পাঠানোসহ নানা লেনদেন করা যাচ্ছে ঘরে বসেই। করোনার মধ্যে এসব সেবার চাহিদা বাড়ছে।