ডিজিটাল লেনদেন কমার আশঙ্কায় অনুমোদনহীন পিএসও বন্ধে ধীরে চলো নীতি নেওয়া হয়েছে।
গ্রাহক ও মার্চেন্টদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের দিকে বাংলাদেশে কয়েকটি পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটর (পিএসও) কার্যক্রম শুরু করে। এর প্রয়োজনীয়তা বুঝে ২০১৪ সালে ‘পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম রেগুলেশন’ হালনাগাদ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আওতায় ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো এসএসএল কমার্জকে পিএসও লাইসেন্স বা অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর অনুমোদন পায় আরও চারটি পিএসও।
তবে অনুমোদনের বাইরে সেবা দিচ্ছে আরও কমপক্ষে ১০টি পিএসও। অর্থাৎ ১৫ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টিই বা দুই-তৃতীয়াংশেরই অনুমতি নেই। এ রকম একটি হলো ফস্টার পেমেন্ট গেটওয়ে, যেখানে আটকে গেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেসব পিএসও অনুমোদন ছাড়াই চলছে, তাদের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব দেখার দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
পিএসওগুলো মূলত ব্যাংকের কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার (এমএফএস) লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে। এখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, হোটেল, খুচরা ও পাইকারি পণ্য বিক্রেতা, সুপারশপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পিএসওর মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে। মূলত অনলাইনভিত্তিক লেনদেনগুলো পিএসওর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
এই সেবা দিতে পিএসওগুলোকে ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। আবার সেবা বা পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সম্পর্ক থাকতে হয়, যাতে ব্যাংকের গ্রাহকেরা পণ্য বা সেবা নিয়ে ব্যাংকের হিসাব, কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করতে পারে। এ জন্য যার যত চুক্তি, তার তত ব্যবসা।
যেসব পিএসও অনুমোদন ছাড়াই চলছে, তাদের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।মো. সিরাজুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করার পর ২০১৯ সালে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এমএফএস) চিঠি দিয়ে অনুমোদনহীন পিএসওর সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার নির্দেশ দেয়। তখন অনুমতি না থাকা অনেক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। তবে করোনার মধ্যে অনলাইন কেনাকাটা ও বিল পরিশোধ চাঙা হওয়ায় পিএসওগুলোর মাধ্যমে লেনদেনও গতি পায়। ব্যবসা আরও বড় হয়। এমতাবস্থায় ডিজিটাল লেনদেন কমে যাওয়ার আশঙ্কায় ও পিএসওগুলো পুরোনো সেবাদাতা হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধীরে চলো নীতি নেয়।
সাধারণত কার্ডের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণে ১০০ টাকার সেবা বা পণ্য বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান ৯৮ টাকা পায়। বাকি ২ টাকার মধ্যে বড় অংশ যায় ব্যাংকের কাছে, কিছুটা পায় পিএসও। একইভাবে বিকাশ, রকেট ও নগদের লেনদেনেও সেবা বা পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আরও কিছুটা কম অর্থ পায়।
আবার দেশের সাতটি ব্যাংক কার্ড ব্যবসার পাশাপাশি পিএসওর মতো সেবার সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকগুলো হচ্ছে দি সিটি, ইস্টার্ণ, ডাচ্-বাংলা, ব্র্যাক, সাউথইস্ট, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ও ইউসিবিএল। এসব ব্যাংক পয়েন্ট অব সেলস ও কিউআর কোডের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের কার্ডের লেনদেন গ্রহণের ব্যবস্থা করেছে। পাশাপাশি বিকাশ, রকেট ও নগদও এখন সরাসরি লেনদেন মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এর মাধ্যমে সেবা বা পণ্য বিক্রেতারা সরাসরি নিজ হিসাবে লেনদেন নিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত পাঁচ পিএসও হলো আইটি কনসালট্যান্টস, এসএসএল কমার্জ, সূর্যমুখী লিমিটেড, প্রগতি সিস্টেম ও পর্টোনিক্স লিমিটেড। এর মধ্যে লেনদেনের ৮০ শতাংশ হয় এসএসএল কমার্জের মাধ্যমে।
অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নথিপত্র জমা দিয়েছে আমার পে, ইজি পে ওয়ে, পে স্পেস, ওয়ালেট মিক্স ও ফস্টার পেমেন্ট গেটওয়ে। এর বাইরে বিডি স্মার্ট পে, বিটিটি পে, পোর্ট ওয়ালেট, টু চেক আউটসহ আরও কয়েকটি পিএসও সেবা দিচ্ছে।
এর মধ্যে ফস্টার পেমেন্ট গেটওয়ে ও ইজি পে ওয়ে—দুটোই হলো ডট লাইনসের প্রতিষ্ঠান। এ দুটো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিতে গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপত্তি জানায় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। গত সেপ্টেম্বরে বিএফআইইউ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) জানায়, ডট লাইনসের চেয়ারম্যান মাহবুবুল মতিন মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত এবং সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফস্টার পেমেন্ট গেটওয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এমন পরিস্থিতিতে ফস্টার পেমেন্ট গেটওয়ে ও ইজি পে ওয়ের পর্ষদে কিছুটা পরিবর্তন আসে। যদিও এখনো সিংহভাগ শেয়ারের অংশীদার ডট লাইনস। ইজি পে ওয়ে বিজনেস বিভাগের প্রধান জাঈদ রানা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০১১ সাল থেকে ব্যবসা করছি। ২০১৬ সালে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছি। শেষ পর্যন্ত লাইসেন্স হয়নি। তবে আমরা নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লেনদেন তথ্য জমা দিচ্ছি।’
ডট লাইনসের বাংলাদেশের কার্যালয় গুলশানের উদয় টাওয়ারে। সেখান থেকে আরও পরিচালিত হয় ডট লাইনসের ইন্টারনেট সেবা কার্নিভ্যাল ইন্টারনেট, বিমা সেবা কার্নিভ্যাল এসুর, প্রবাসীর লেনদেন সেবা সহজ।
ডট লাইনসের চেয়ারম্যান মাহবুবুল মতিন মালয়েশিয়ায় থাকেন, সিঙ্গাপুরেও তাঁর ব্যবসা রয়েছে।