বিশ্লেষণ

সুইস ব্যাংক নিয়ে কেবল বক্তৃতা

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামে, এমনকি বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়। তখন সরকার থেকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলা হয়েছিল, ক্ষমতায় থাকলে সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা রেখেছে, তা বের করা হবে। কেবল বেরই করা হবে না, দেশেও ফিরিয়ে আনা হবে।

আর ২৮ জুন জাতীয় সংসদকে জানানো হয়, সরকার আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবে। আর পাচার হওয়া অর্থ সুইস ব্যাংক থেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সরকারের সেই বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতির আট বছর পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে ১০ জুন জানালেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করেছে, এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।’

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ ফেরত আনা তো দূরের কথা, সুইস ব্যাংক থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাই বাংলাদেশের নেই। অথচ বিশ্বের ১২১টি দেশ সুইস ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের তথ্য পাচ্ছে। সুইস ব্যাংক–ব্যবস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো আছে। এর নাম হচ্ছে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই)। ২০১৭ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময়ের এই আন্তর্জতিক কাঠামো চালু রয়েছে।

শুরু হয়েছিল জি-২০ এবং ওইসিডিভুক্ত ৩৮টি দেশের হাত ধরে। মূলত এটি করা হয় কর ফাঁকি ধরার উদ্দেশ্যে। কোনো দেশের নাগরিক যদি নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন, তাহলে সেই তথ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে এই কাঠামোর আওতায়।

এর বাইরে তথ্য পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে একটি পৃথক আইন। ২০১০ সালে পাস করা যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্ট’-এ বলা আছে, কোনো মার্কিন নাগরিক অন্য দেশের কোনো ব্যাংকে অর্থ রাখতে চাইলে সে তথ্য তাদের দিতে হবে।

আর তা না মানলে ওই ব্যাংককে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হবে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র একাধিক সুইস ব্যাংককে বিপুল পরিমাণ অর্থ জরিমানা করলে সুইজারল্যান্ড স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান–প্রদানের একটি আইনি কাঠামোয় অংশগ্রহণ করতে সম্মতি জানিয়েছিল। এই ব্যবস্থায় কর ফাঁকি বা অন্য কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তির তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলে তা দিতে বাধ্য সুইস ব্যাংকগুলো।

স্বয়ংক্রিয় এই তথ্য আদান–প্রদান ব্যবস্থায় যুক্ত আছে ১২১টি দেশ। আরও ৪২টি দেশ এতে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। ওইসিডির ওয়েবসাইটে সব দেশের নাম পাওয়া যায়। এতে কেবল নাম নেই বাংলাদেশের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ কেবল বক্তৃতা-বিবৃতিই দিয়ে গেছে। কিন্তু তথ্য পাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই করেনি, আন্তর্জাতিক কাঠামোর মধ্যে যুক্ত হওয়ার কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেয়নি।

২০১৫ সালে একবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে যখন সুইস ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে তথ্য দেওয়ার আন্তর্জাতিক কাঠামোতে সম্মতি দেয়, তখন আর বাংলাদেশ তাতে যুক্ত হতে উদ্যোগী হয়নি। ফলে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে ধারণার ওপর বলতে হয়, ‘বাংলাদেশিদের পাচার করা এবং সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের ৯৫ শতাংশ অন্য দেশ থেকে আনা।’

প্রতিবছরই এখন সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে কোন দেশের নাগরিকের কী পরিমাণ অর্থ জমা আছে, তার একটি হিসাব দেয়। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কী পরিমাণ অর্থ আছে, তা প্রথম জানা যায় ২০০৪ সাল থেকে। তবে এ নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে লেখালেখি শুরু হয়েছিল ২০১৪ থেকে।

সাধারণত জুন মাসে রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। শুরুতে রিপোর্ট প্রকাশের পরে এ নিয়ে লেখালেখি হলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতেন। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন। কয়েক বছর ধরে অবশ্য কথা বলার সুর পাল্টে গেছে। এখন একটাই কথা, এ অর্থ বাংলাদেশ থেকে যায়নি। আসলে কোথা থেকে গেছে, কার অর্থ গেছে, তা জানার কোনো সুযোগই বাংলাদেশের নেই, যা অন্য অনেক দেশের আছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করা আইন ও পরে জি-২০–ভুক্ত দেশগুলোর কঠোর অবস্থানের কারণে বিপাকেই পড়ে গিয়েছিল সুইস ব্যাংকগুলো। সেখানে অর্থ রাখা কমে যাচ্ছিল। বরং করস্বর্গ নামে পরিচিত লুক্সেমবার্গ, বাহামা, কেম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, পানামা, হংকং বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশে অর্থ রাখার প্রবণতা বেড়ে যায়। কিন্তু করোনাকালে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে গেছে। দেখা যাচ্ছে, ওই দুই বছরে সুইস ব্যাংকে প্রায় সব দেশেরই অর্থ রাখার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। ওই সময় অর্থের চাহিদা ছিল কম, যাতায়াতের সুযোগও ছিল না। ফলে ব্যাংকেই অর্থ ঢুকেছে বেশি।

আন্তর্জাতিক কাঠামোয় যুক্ত থেকে তথ্য পাওয়া শুরু করায় ২০১৯ সাল পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের রাখা অর্থ বিপুলভাবে কমে গিয়েছিল, সেখানে পরপর দুই বছর নতুন রেকর্ড হয়েছে। ভারতের এবার সুইস ব্যাংকে জমা অর্থ বেড়েছে ৫০ শতাংশ, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। নেপাল ও পাকিস্তানেরও বেড়েছে। কমেছে কেবল বিপদে থাকা শ্রীলঙ্কার।

নতুন রেকর্ড করেছে বাংলাদেশও। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ।

কোভিডকালে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় এসেছে রেকর্ড পরিমাণ, প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ শতাংশের বেশি। আবার একই সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে কালোটাকা সাদা হয়েছে ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর এখন দেখা যাচ্ছে সুইস ব্যাংকেও বাংলাদেশিদের বিপুল অর্থ ঢুকেছে। সুতরাং সারা বিশ্বে চলাচল বন্ধ থাকা, কম চাহিদা এবং অর্থ ব্যবহারের তেমন সুযোগ থাকার সঙ্গে এর সম্পর্ক কতটা, এটাই এখন বড় প্রশ্ন।