ব্যাংকটিতে কী ধরনের অনিয়ম ও কত টাকা পাচার হয়েছে, তার খোঁজে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক প্রায় ছয় শ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে, যার কোনো অনুমোদন ছিল না। এমনকি এসব ঋণের বেশির ভাগের কোনো নথিপত্র ব্যাংকটিতে মিলছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এসব নথিপত্র খুঁজে পাচ্ছেন না। আর এ নিয়ে তদন্ত চলায় ব্যাংকটির পরিচালনাও পর্ষদও এখন বিতরণ করা এসব ঋণের অনুমোদন দিতে চাইছে না। যদিও এসব ঋণ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকটির পরিচালক পদে থাকা সিকদার পরিবারের এক সদস্যের নির্দেশে।
এ নিয়ে সিকদার পরিবারের মধ্যে তৈরি হয়েছে গৃহবিবাদ। ভাইয়েরা এক পক্ষে, বিপরীতে আছেন এক বোন। এক পক্ষ চাচ্ছে অনিয়ম অনুমোদনের, অন্য পক্ষ অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চায়।
এদিকে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বরের পর যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ঋণের বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এরপর ন্যাশনাল ব্যাংকে কী ধরনের অনিয়ম ও কত টাকা পাচার হয়েছে, তার খোঁজে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এই ইউনিটের কর্মকর্তারা ৭ ও ৮ এপ্রিল ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়, মহাখালী ও গুলশান করপোরেট শাখায় তদন্ত করেন। আইনত বিএফআইইউ অর্থ পাচার তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ এখন যৌথভাবে ব্যাংকটির সামগ্রিক কার্যক্রম খতিয়ে দেখছে।
বিএফআইইউ প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান ৮ এপ্রিল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ পাচারের কোনো ঘটনা থাকলে সে বিষয়ে তদন্ত করাটা আমাদের দায়িত্ব। ব্যাংকটির বিভিন্ন অর্থ পাচারের কয়েকটি বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুরোধ করেছে, বিভিন্ন মাধ্যমেও তাদের অনিয়মের বিষয় এসেছে। জরুরি হওয়ায় করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের তদন্ত কর্মকর্তারা ন্যাশনাল ব্যাংকে কাজ করছেন।’
জানা গেছে, গত ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় সবশেষ ঋণ অনুমোদিত হয়। এরপর সভা হলেও কোনো ঋণ অনুমোদিত হয়নি। তবে ঠিকই ব্যাংকটি ৬২৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে, যা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। এসব অনিয়মে সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এ এস এম বুলবুলকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকটির নথিপত্রে তাঁর প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
# পর্ষদ সভার অনুমোদন ছাড়াই ৬২৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ# ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণের অর্ধেকের বেশি ১৫টি গ্রুপের কাছে
ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণের পূর্ণাঙ্গ হালনাগাদ বিবরণী সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এই নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত তিন মাসে শান্তানা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ১৬৪ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য সরঞ্জাম আমদানির নামে প্রতিষ্ঠানটি ঋণপত্র খোলে, তবে এখনো পণ্য আসেনি। যদিও ব্যাংকটির ঋণের নথিতে দেখানো হয়েছে এটি আবাসন নির্মাণ খাতের ঋণ হিসেবে। এই প্রতিষ্ঠানটির একজন মালিকের বাসায় ব্যাংকটির গুলশানের শাখা। এই সূত্রে ব্যাংকটির কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। এ কারণেই অনুমোদন ছাড়া ঋণ পায়।
একই সময়ে ফ্রেন্ডস মাল্টি ট্রেড কোম্পানির নামে ৮৩ কোটি, স্টেপ মিডিয়ার নামে ১৮ কোটি, রূপায়ণ হাউজিং লিমিটেডের নামে ৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। আবার মৌখিক অনুমোদনে সিনহা অ্যান্ড ওপেক্স ইন্ডাস্ট্রিজকে দেওয়া হয় ৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া একই সময়ে সাইফ পাওয়ার হোল্ডিং, বেক্সিমকো এলপিজি, আলেশা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সার্ভিসেস, গচিয়াটা অ্যাকুয়াকালচার, সিএলসি পাওয়ার, অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যাল, ডাইরেক্ট ফ্রেশ, খান সন্স বিডি, দ্য ফাইনারি লিমিটেড, ড্রিম প্লাস, ফ্যাশন ফ্লাশ, গ্লোব ট্রাভেল সার্ভিসেস, গ্লোবাল এমব্রয়ডারি ও তানজিলা টেক্সটাইলের নামে ঋণ বিতরণ করা হয়। তবে এসব ঋণে পরিচালনা পর্ষদের কোনো অনুমতি ছিল না। এমনকি ঋণ প্রদানের কোনো অনুমতিপত্রও নেই।
তদন্তকাজে যুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকটি এসব ঋণের নথিপত্র দেখাতে পারছে না। শুধু ঋণ বিতরণের নথি রয়েছে। ঋণের টাকা কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে, তারও কোনো তথ্য মিলছে না। তদন্ত শেষ হলেই প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার মারা যাওয়ার পর ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। জয়নুল হক সিকদার চেয়ারম্যান থাকাকালীন ব্যাংকটির পরিচালনা করতেন তাঁর দুই ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার। চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর ব্যাংকটি পরিচালনা নিয়ে পরিচালকদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। এই বিভক্তি প্রকট হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারির পরিচালনা পর্ষদে। সেদিন নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে বিতরণ করা ঋণের অনুমোদনের প্রস্তাব উঠলে তাঁর মেয়ে ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার বিরোধিতা করেন। তাঁকে সমর্থন দেন সিকদার পরিবারের বাইরের পরিচালকেরাও। ফলে এসব ঋণ আর অনুমোদিত হয়নি।
এখন রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার চাইছেন ব্যাংকটি তাঁদের একক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর মেয়ে সাংসদ পারভীন হক সিকদার ও অন্য পরিচালকেরা চাইছেন ব্যাংকটির যে ভাবমূর্তি নষ্ট ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে। এ জন্য তাঁর ভাইদের হাত থেকে ব্যাংকটি রক্ষা করতে চাইছেন। পাশাপাশি এমডি পদে এ এস এম বুলবুল যাতে কোনোভাবে নিয়োগ না পান, তার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ এস এম বুলবুলকে ইতিমধ্যে এমডি পদে দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার তাঁর ছেলেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার ব্যাংকের পরিচালক। এ ছাড়া সিকদার গ্রুপের কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া ও বদিউল আলমও ব্যাংকটির পরিচালক এবং দুই ছেলের পক্ষে।
তাঁদের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া মেয়ে পারভীন হক সিকদারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছেন কেডিএস গ্রুপের খলিলুর রহমান, হোসাফ গ্রুপের মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাবরুর হোসেন এবং জাকারিয়া তাহের। তাঁরা চাইছেন ব্যাংকটিতে নতুন করে আর অনিয়ম না হোক।
ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির (ইসি) চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৬ ডিসেম্বরের পর কোনো ঋণ অনুমোদিত হয়নি। ইসি কমিটির প্রধান হিসেবে আমাকেও কিছু জানানো হয়নি। তাই যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার দায়ভার অবশ্যই এমডিসহ অন্য কর্মকর্তাদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত শেষ হোক, এরপরই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংকে নতুন করে কোনো অনিয়ম হতে দেওয়া হবে না।’
ব্যাংকটির গত ফেব্রুয়ারিভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ ১৫টি গ্রুপের কাছে। ব্যাংকটির সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা এস আলম গ্রুপের ঋণ ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে যা ছিল ২ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা। সদ্য প্রয়াত সাংসদ আসলামুল হকের মায়শা গ্রুপের ঋণ ২ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে যা ছিল ২ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণ ২ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে যা ছিল ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ ১ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে যা ছিল ১ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। নাসা গ্রুপের ঋণ ১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে যা ছিল ১ হাজার ২১৪ কোটি।
এ ছাড়া ব্যাংকটির বড় ঋণের সুবিধাভোগী আরও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনালের ঋণ ৬৬৩ কোটি টাকা, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের ৬১৫ কোটি টাকা, হেল্পলাইন রিসোর্সের ২৫৮ কোটি টাকা, ইপসু ট্রেডিংয়ের ১৫২ কোটি টাকা, গ্রান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজের ১৪৩ কোটি টাকা।
এ এস এম বুলবুলকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমানে এমডি পদে কেউ দায়িত্বে নেই। ফলে কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত এমডি এ এস এ বুলবুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
ন্যাশনাল ব্যাংকের শুরুর দিকে কর্মী ছিলেন এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ নূরুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটা ব্যাংক ভালো অবস্থা থেকে কোথায় এসে থেকে দাঁড়িয়েছে, এটা জেনেই খারাপ লাগে। আমানতকারীদের স্বার্থে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে হবে। এ জন্য অনিয়মে জড়িত পরিচালক ও কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে অন্যদের দায়িত্ব দিতে হবে। আর কাউকে ধরবে, কাউকে ছাড়বে ভূমিকা থেকে বের হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হবে। একজন দক্ষ এমডি নিয়োগ দিয়ে তাঁকে ক্ষমতা দিতে হবে। অনুমোদন ছাড়া ঋণ বিতরণ বন্ধ করে সবাইকে নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। তাহলেই ব্যাংকটি ভালো অবস্থায় আবার যেতে পারবে।