রন ও রিকের ক্রেডিট কার্ড বাতিলের উদ্যোগ

রন হক ও রিক হক
রন হক ও রিক হক

ন্যাশনাল ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত ১ কোটি ৩৫ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮০ ডলার খরচ করেছেন সিকদার পরিবারের ৯ সদস্য। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ১১৬ কোটি টাকা। ২০১৭-২১ এই পাঁচ বছরে তাঁরা কার্ডের মাধ্যমে বিদেশে এই খরচ করেন। এ জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের কার্ড সেবা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কার্ডের মাধ্যমে এত ডলার বিদেশে চলে গেল, এটাও সম্ভব। এখনই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি ব্যাংক তো গুটিকয়েক ব্যক্তির জন্য নষ্ট হতে পারে না
সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ

পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিধিবহির্ভূত লেনদেন করায় ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রন হক সিকদার ও সাবেক পরিচালক রিক হক সিকদারের কার্ডের হিসাব বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই খরচের (ঋণের) তথ্য গোপন করায় ইতিমধ্যে ব্যাংকটিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আর নিয়মের বাইরে লেনদেন করায় মতিঝিলের দিলকুশা ও পশ্চিম ধানমন্ডি শাখার এডি (বিদেশি মুদ্রার ব্যবসার) লাইসেন্স বাতিল করতে চায় বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকানায় থাকা সিকদার পরিবারের একাধিক সদস্যদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সীমার বেশি ডলার খরচ করার তথ্য উঠে আসে। এরপরই কেন এসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ২২ ডিসেম্বর চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৭ কর্মদিবসের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হলেও ব্যাংকটি বাড়তি সময় চেয়েছে।

ন্যাশনাল ব্যাংক পরিদর্শনে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে নিয়মের বাইরে খরচ করার প্রমাণ মিলেছে। এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ধাপ হিসেবে ব্যাংকটির কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। জবাব আসার পরই সিদ্ধান্ত হবে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম

সিকদার পরিবারের সদস্যরা বিদেশে যেসব ডলার খরচ করেছেন, তা প্রবাসীদের পাঠানো ও রপ্তানির মাধ্যমে উপার্জিত। দেশের ডলারের মজুত (রিজার্ভ) বাড়াতে সরকার জনগণের করের টাকা থেকে দিচ্ছে প্রণোদনা ও রপ্তানিতে ভর্তুকি। কারণ, খাদ্য, মূলধনি যন্ত্র, কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আনতে প্রয়োজন হয় ডলারের। এ জন্য একজন নাগরিক প্রতি বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি খরচ করতে পারেন না। সেই ডলারই সীমার বাইরে খরচ করেছে প্রভাবশালী এই পরিবারের সদস্যরা।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ন্যাশনাল ব্যাংক পরিদর্শনে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে নিয়মের বাইরে খরচ করার প্রমাণ মিলেছে। এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ধাপ হিসেবে ব্যাংকটির কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। জবাব আসার পরই সিদ্ধান্ত হবে।’

ন্যাশনাল ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, সিকদার পরিবারের ৯ সদস্য ও সিকদার গ্রুপের ২ কর্মকর্তার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার নিয়ে অনিয়ম ধরা পড়েছে। পরিবারের যেসব সদস্য এসব কার্ড ব্যবহার করছেন তাঁরা হলেন রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার, দিপু হক সিকদার, মমতাজুল হক ও লিসা ফাতেমা হক। তাঁরা সবাই ব্যাংকটির প্রয়াত চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের সন্তান।

কার্ডে সীমাতিরিক্ত ১১৬ কোটি টাকা খরচ সিকদার পরিবারের সদস্যদের।

এর বাইরে পরিবারের আরও যাঁরা কার্ড ব্যবহার করেছেন, তাঁরা হলেন রিক হক সিকদারের দুই ছেলে জন হক সিকদার ও শোন হক সিকদার। পরিবারের আরেক সদস্য হলেন মনিকা সিকদার খান, তিনি নাসিম হক সিকদারের মেয়ে। নাসিম হক সিকদার হলেন প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের মেয়ে। ওই পরিবারের অপর সদস্য জেফরি সিকদারও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সীমার বেশি ডলার খরচ করেছেন।

এর বাইরে সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সৈয়দ কামরুল ইসলাম ও গ্রুপের কর্মকর্তা ভারভারা জারিনাও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সীমার বেশি ডলার খরচ করেছেন। তারা সবাই একাধিক, এমনকি পাঁচটি পর্যন্ত কার্ড ব্যবহার করছেন।

জানা গেছে, রন হক সিকদারের কয়েকটি কার্ডে ২০১৭-২০ এই তিন বছরে ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার ৮৯২ ডলার খরচ হয়, বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৬০ কোটি টাকা। আর রিক হক সিকদারের কার্ডে একই সময়ে ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৯ ডলার খরচ করা হয়। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৩১ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটি ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) তা দাখিল করেনি। এ কারণে গত ১৩ ডিসেম্বর ব্যাংকটিকে দুই দফায় মোট ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের ধরা পড়া অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাশনাল ব্যাংক জানায়, চেয়ারম্যানের মৌখিক অনুরোধ এবং ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সুপারিশের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডে ভ্রমণ কোটার অতিরিক্ত সীমা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জেড এইচ সিকদার উইমেনস মেডিকেল কলেজের নামে নিয়ম ভেঙে বৈদেশিক মুদ্রা (এফসি) হিসাব খুলেছে ও লেনদেন করেছে ব্যাংকটি। এ জন্য দিলকুশা শাখা ও পশ্চিম ধানমন্ডি শাখার এডি লাইসেন্স কেন বাতিল বা স্থগিত করা হবে না, তা জানতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই হিসাব কেন বন্ধ করা হবে না, তা–ও জানতে চেয়েছে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন জয়নুল হক সিকদার। তিনি মারা যাওয়ায় পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। এ ছাড়া সিকদার পরিবারের একাধিক সদস্য ও সিকদার গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা এই ব্যাংকের পরিচালক। তাঁরাই ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন। বিদায়ী বছরে ব্যাংকটি ২৪৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে।

গত দেড় দশকে ব্যাংকটির বেশির ভাগ এমডি পর্ষদের চাপে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। যে কারণে ২০১৪ সালে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এসব নিয়ে বক্তব্য জানতে ব্যাংকটির নতুন এমডি মেহমুদ হোসেনকে ফোন করা হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কার্ডের মাধ্যমে এত ডলার বিদেশে চলে গেল, এটাও সম্ভব। এখনই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি ব্যাংক তো গুটিকয়েক ব্যক্তির জন্য নষ্ট হতে পারে না।’