মাত্র তিন বছরে মোবাইলে আর্থিক সেবায় (এমএফএস) লেনদেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর গ্রাহকও বেড়েছে সমান হারে। এর ফলে এখন দৈনিক প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, রকেটের মতো সেবার মাধ্যমে। তিন বছর আগেও দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। এ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-কে হিসাবে ধরলে দৈনিক লেনদেন ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এমনিতেই চালু হওয়ার পর থেকে এমএফএস সেবায় ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। আর করোনা এসে তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর ফলে শুধু ২০২০ সালেই লেনদেন বেড়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য মিলেছে। তবে ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’-এর তথ্য যুক্ত প্রতিবেদনে যুক্ত করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, সেবাটি এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নগদের হিসাব যুক্তহলে এ সেবার আওতায় দৈনিক লেনদেন ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। নগদের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ।
জানতে চাইলে তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করছি আগামী মার্চের মধ্যে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পেয়ে যাব। আর সারা দেশে সেবা ছড়িয়ে দিতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর মাসজুড়ে এমএফএসে লেনদেন হয়েছে ৫৬ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। ফলে ডিসেম্বর শেষে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিকাশের দৈনিক লেনদেন ছিল গড়ে ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চে। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে ‘বিকাশ’। বিকাশের ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, ইউক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ নানা নামে ১৬টি ব্যাংক এ ধরনের সেবা দিচ্ছে। এখন ট্রাস্ট ব্যাংক ও আজিয়াটা ডিজিটাল মিলে আনছে নতুন সেবা ‘ট্যাপ’।
বিগত কয়েক বছরে অনেক প্রতিষ্ঠান এ সেবায় যুক্ত হলেও এখনো সেবামাশুল অনেক বেশি বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। বর্তমানে এক হাজার টাকা তুলতে একজন গ্রাহককে খরচ করতে হয় সাড়ে ১৮ টাকা। যদিও এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, যে মাশুল আদায় হয়, তার ৬০ শতাংশের বেশি এজেন্টদের দেওয়া হয়। এরপর নেটওয়ার্ক খরচ দিতে হয়। বাকিটা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় খরচ হয়। দিন শেষে মুনাফা হয় খুব কম। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত ডিসেম্বরের শেষে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক হিসাবে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি জমা ছিল। গ্রাহকের হিসাবে জমা থাকা এসব অর্থের বিপরীতে সুদ আয় করে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো।
জানা গেছে, গত ডিসেম্বর শেষে এমএফএসে গ্রাহক হিসাব ছিল ৯ কোটি ৯৩ লাখ। সক্রিয় গ্রাহক ছিল ৩ কোটি ২৩ লাখ। আর ২০১৭ সালের শেষে গ্রাহক হিসাব ছিল ৫ কোটি ৮৮ লাখ, এর মধ্যে সক্রিয় ছিল ২ কোটি ১০ লাখ। ২০১৯ সালের শেষে গ্রাহক হিসাব ছিল ৭ কোটি ৯৫ লাখ আর সক্রিয় গ্রাহক ছিল ৩ কোটি ৪৬ লাখ। সেই হিসাবে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০ সালে সক্রিয় গ্রাহক হিসাব কমে গেছে। তবে এই সময়ে লেনদেন বেড়ে গেছে।
জানতে চাইলে বিকাশের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, বিকাশে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সেবা যুক্ত
হচ্ছে। ফলে গ্রাহকও বাড়ছে। গ্রাহকদের আরও কীভাবে সহজে সেবা দেওয়া যায়, বিকাশ তা নিয়ে কাজ করছে।
এদিকে এমএফএস চালুর ফলে শুধু কম আয়ের মানুষের সুবিধা হয়েছে, বিষয়টা তেমন না। বড় করপোরেট ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পমালিকেরাও এর সুবিধা পেয়েছেন। এখন দেশের সব বড় ভোগ্যপণ্য প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রির টাকা এ সেবার মাধ্যমে সংগ্রহ করছে, যাকে কালেকশন সেবা বলছে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার অনেক বড় শিল্প গ্রুপ তাদের শ্রমিকের বেতনও দিচ্ছে এমএফএসের মাধ্যমে।
শুধু তা-ই নয়, সরকারি ভাতা, বৃত্তি, কেনাকাটা, পরিষেবা বিল পরিশোধ—সবই করা যাচ্ছে। আবার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ ও আদায় এবং বিদেশি সংস্থার তহবিল বিতরণও হচ্ছে এসব সেবার মাধ্যমে। করোনায় এসব সেবার ব্যবহার অনেক বেড়েছে।