ব্যাংকারদের পাশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

গতকাল এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আগামী মার্চ মাস থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক

বেসরকারি খাতের ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা ও অদক্ষতার অজুহাতে কাউকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এ ছাড়া ব্যাংকারদের চাকরির সুরক্ষায় আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এত দিন ব্যাংকের পরিচালক ও বড় গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও এবার ব্যাংকারদের পাশে দাঁড়াল। করোনাকালে কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমানো ও চাকরিচ্যুতির ঘটনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন উদ্যোগ নিল।

গত বছর বেসরকারি ছয়টি ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে উঠে এসেছে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ৩ হাজার ৩১৩ জন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন ৩ হাজার ৭০ জন। বাকিদের মধ্যে ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই, ২০১ কর্মকর্তাকে অপসারণ ও ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু যেসব কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন বলে ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, সেটাকে অস্বাভাবিক ঘটনা মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে আলোচনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সর্বনিম্ন বেতনসহ বিভিন্ন বিষয় জানতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল বৃহস্পতিবার বেসরকারি ব্যাংক খাতের বেতন-ভাতা বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যা আগামী মার্চ থেকে কার্যকর হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ট্রেইনি সহকারী কর্মকর্তা (ক্যাশ) ও জেনারেল এবং সহকারী কর্মকর্তাদের সর্বনিম্ন বেতন হবে ২৮ হাজার টাকা, শিক্ষানবিশকাল শেষ হলে বেতন-ভাতা দাঁড়াবে ৩৯ হাজার টাকা। অফিস সহকারী, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও মেসেঞ্জারদের সর্বনিম্ন বেতন হবে ২৪ হাজার টাকা। পাশাপাশি যেসব ব্যাংক তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সেবা দেয়, তাদের বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে অফিস সহায়কের বেতনকে বিবেচনায় নিতে হবে। তবে এই নির্দেশনা এজেন্ট ব্যাংকিং কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

■ শিক্ষানবিশকালে ট্রেইনি সহকারী কর্মকর্তা (ক্যাশ), জেনারেল ও সহকারী কর্মকর্তাদের সর্বনিম্ন বেতন ২৮ হাজার টাকা, যা শিক্ষানবিশকাল শেষে দাঁড়াবে ৩৯ হাজার টাকা। ■ কর্মচারীদের সর্বনিম্ন বেতন হবে ২৪ হাজার টাকা। ■ লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা ও অদক্ষতার অজুহাতে কাউকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পরের পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে নিম্ন পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পার্থক্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। তবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা কমানো যাবে না। এ ছাড়া চাকরি স্থায়ীকরণ ও বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকারদের আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যও বেঁধে দেওয়া যাবে না।

নতুন নির্দেশনা তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, কোনো কোনো ব্যাংকের এমডি প্রতি মাসে সুযোগ-সুবিধা বাদে শুধু বেতনই তোলেন ২০ লাখ টাকার বেশি। আর ওই ব্যাংকেরই সর্বনিম্ন পদের কর্মকর্তাকে কিনা মাসে দেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকার কম। অথচ দুজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা কাছাকাছি। এভাবে উচ্চ পদের সঙ্গে নিম্ন পদের কর্মকর্তাদের বেতনের পার্থক্য অনেক হয়ে গেছে। পাশাপাশি যখন-তখন চাকরি ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে। সে জন্য এক রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যাতে অধিকতর উজ্জীবিত হয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং ব্যাংকেও যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান আবশ্যক বলে প্রতীয়মান হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিষ্ঠা, নৈতিকতা, মনোবল ও কর্মস্পৃহা অটুট রাখতে তাঁদের যথাযথ বেতন-ভাতা প্রদান আবশ্যক। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে যে কিছু ব্যাংকে প্রথম ধাপের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা যথাযথভাবে নির্ধারণ না করে ইচ্ছামাফিক করা হচ্ছে, যা উচ্চপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার তুলনায় খুবই কম। উচ্চ ও নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার মধ্যে এ রকম অস্বাভাবিক ব্যবধান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আরও দেখা গেছে, কোনো কোনো ব্যাংকে একই পদে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ভিন্ন ভিন্ন বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। তা ছাড়া নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারা বা অদক্ষতার অজুহাত তোলা ও বেতন-ভাতার ভিন্নতার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে একনিষ্ঠ ও অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে কাজ করার মনোভাব গড়ে ওঠে না। এতে অদক্ষতা, অসম প্রতিযোগিতা ও নৈতিক অবক্ষয়সহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতার উদ্ভব হয়, যা সুষ্ঠুভাবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় এবং ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।