কাজ ৪৭ শতাংশ হলেও ফ্লোরা টেলিকমকে ৪১০ কোটি টাকা দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এর মধ্যেই আবার চিঠি জাল করেছে তারা। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রযুক্তি আধুনিকায়নের মাধ্যমে পুরো ব্যাংকিং সেবার চিত্র পাল্টে দিতে চেয়েছিল অগ্রণী ব্যাংক। ফ্লোরা টেলিকম চার দফায় ৪৯৯ কোটি টাকায় এ কাজ পায়। চুক্তি অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের টেমোনাস কোম্পানির কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার (সিবিএস) স্থাপন করবে ফ্লোরা টেলিকম। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৪৭ শতাংশ। যদিও ফ্লোরা টেলিকমকে ৪১০ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক।
এর বাইরে অগ্রণী ব্যাংকের আরও কাজ পেয়েছে, এ রকম একটি চিঠি জাল করে টেমোনাসের কাছে পাঠায় ফ্লোরা টেলিকম। চিঠি জাল করার তথ্য জানতে পেরে টেমোনাস ফ্লোরার সঙ্গে চুক্তি বিচ্ছিন্ন করে। এর মধ্যেই আগামী ৩১ মার্চ থেকে সিবিএসের টি-২৪ ভার্সনের রক্ষণাবেক্ষণ সেবা বন্ধের ঘোষণা দেয় টেমোনাস। এটা জানার পরও ফ্লোরা টেলিকমের সঙ্গে ১০ বছরের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি করেছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক। এমনকি ৮৮ কোটি টাকাও পরিশোধ করেছে।
এখন এই সফটওয়্যার নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে ব্যাংকটি। ব্যাংকটির কার্যক্রমের অর্ধেক চলছে কাগজে–কলমে, বাকিটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ব্যাংকটিতে যে সিবিএস চলছে, তা পদে পদে ভোগাচ্ছে কর্মকর্তাদের। যেমন এই সফটওয়্যারটিতে খেলাপি গ্রাহকদের ঋণপত্র অবাধে খোলা যাচ্ছে। আর ঋণ হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খেলাপি অংশকে আলাদা করছে না। আবার ঋণ সম্পূর্ণ পরিশোধের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে প্রত্যয়নপত্রে দেওয়ার কথা, তা–ও দিচ্ছে না। এতে ঋণ না থাকা গ্রাহক হিসাবের ওপর বিভিন্ন ধরনের মাশুল চাপছে। গ্রাহকদের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারাও। কারণ, সব নথিপত্র নতুন করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে গ্রাহকদের সমস্যার সমাধান করতে হচ্ছে।
অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারাই বলছেন, ফ্লোরা টেলিকম সেবা দেওয়ার নামে একধরনের ছলচাতুরী করেছে। আর এতেই ফেঁসে গেছে পুরো অগ্রণী ব্যাংক। এর সঙ্গে ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা জড়িত, যাঁদের সমর্থন দিয়েছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। কোনো কোনো পরিচালকও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালে কাজ পায় ফ্লোরা টেলিকম। ওই সময়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন খন্দকার বজলুল হক এবং বর্তমানে জায়েদ বখত।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এসেছে, এই সিবিএস স্থাপন (ইনস্টল) থেকে শুরু করে হালনাগাদ পর্যন্ত পদে পদে অনিয়ম হয়েছে, যাতে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। এমনকি অগ্রণী ব্যাংক সিবিএস শতভাগ বাস্তবায়নের মিথ্যা তথ্য দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। টেমোনাসকে অর্থ পাঠাতে ফ্লোরা টেলিকম অবৈধ চ্যানেলও ব্যবহার করেছে। তাই জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ সেবা বাতিল হবে, এটা জানার পরও কেন ফ্লোরাকে ৮৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে ব্যাংকটির এমডির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
* ব্যাংকটির কার্যক্রমের অর্ধেক চলছে কাগজে–কলমে, বাকিটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে। * ফ্লোরা টেলিকমের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে সুইজারল্যান্ডের টেমোনাস * বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সিবিএস স্থাপনে পদে পদে অনিয়ম হয়েছে, জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তারা
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলামও বিষয়টি স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা সেভাবে কম্পিউটার ব্যবহার জানতাম না। ফ্লোরা তখন থেকে আমাদের সেবা দিয়ে আসছে। তাদের সেবা নিয়ে এখন আমরা বিপদে পড়ে গেছি। এখন নতুন প্রতিষ্ঠান খুঁজছি, যারা সিবিএস রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে কাজ করবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ চেয়েছি।’
ফ্লোরার জাল চিঠি
সব শাখায় আধুনিক অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১০০টি স্থানে অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানের জন্য ২০০৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ১৬ কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব অনুমোদন করে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এরপর ২০০৮ সালে নিলামের মাধ্যমে কাজটি পায় ফ্লোরা টেলিকম। সময়ে সময়ে আরও বেশি শাখাকে এ সেবার আওতায় আনার জন্য ফ্লোরাকে কাজ দেয় ব্যাংকটি। এ জন্য ২০০৮ সালে প্রথম দফায় ২১ কোটি ৯২ লাখ টাকা, ২০১২ সালে ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং ২০১৩ সালে ১৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার কাজ দেওয়া হয়।
ফ্লোরার সঙ্গে প্রথম চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরেই টি-২৪ সফটওয়্যারের লাইসেন্স নবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ২৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বাজেট অনুমোদন হয় এবং ফ্লোরার সঙ্গে নতুন করে চুক্তি হয়। এর মধ্যেই ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি টেমোনাস ই–মেইলের মাধ্যমে জানায়, টি-২৪ সফটওয়্যারের সহায়তা সেবা আগামী ৩১ মার্চ থেকে সারা বিশ্বে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপরও ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ১০ বছরের লাইসেন্স নবায়ন বাবদ ফ্লোরা টেলিকমকে ৮৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দেয় ব্যাংকটি। ওই বছরের ২২ মে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেয় আরও ৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
ফ্লোরার সেবা নিয়ে এখন আমরা বিপদে পড়ে গেছিমোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম, এমডি, অগ্রণী ব্যাংক
সহায়তা সেবা বন্ধ করে দেওয়ার সংবাদে বিপদে পড়ে যায় ব্যাংকটি। সফটওয়্যার হালনাগাদের কাজ ফ্লোরাকে আর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অগ্রণী ব্যাংক। নতুন করে সফটওয়্যার হালনাগাদের কার্যাদেশ দেওয়া না হলেও ফ্লোরা টেলিকম একটি জাল চিঠি তৈরি করে টেমোনাসকে পাঠায়। টেমোনাস বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য অগ্রণী ব্যাংককে পাঠালে বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপরও ফ্লোরার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংকটি।
২০২০ সালের ২৬ জুন টেমোনাসের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এমডি মার্টিন ক্রিক অগ্রণী ব্যাংককে জানায়, ফ্লোরা টেলিকমের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়েছে। তারা আর টেমোনাস সেবার বৈধ গ্রাহক নয়। ফ্লোরার সঙ্গে থাকা অগ্রণীর চুক্তি অনুযায়ী, এখন ফ্লোরার কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে ব্যাংকটি। তবে এখনো অগ্রণী ব্যাংক এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ নিয়ে ফ্লোরা টেলিকমের বক্তব্য জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা রফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে চেষ্টা করে বন্ধ পাওয়া গেছে। তিনিই মূল মালিক। ফ্লোরা টেলিকমের মতিঝিল ও গুলশান কার্যালয়ে গিয়েও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ১০ ফেব্রুয়ারি রফিকুল ইসলাম ও টেমোনাসকে মেইল করা হলেও কোনো উত্তর মেলেনি। ফলে তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ
এর পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রণী ব্যাংককে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, টেমোনাসের বিদ্যমান সেবা বন্ধ হয়ে যাবে, এটা জানার পরও ফ্লোরা টেলিকমকে ৮৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার সিবিএস সেবা নবায়নের ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনা না করে ৫ হাজার ১৫০ জন ব্যবহারকারীর লাইসেন্স ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, যার দায়দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। এ ছাড়া ৩৮টি শাখায় সফটওয়্যার বাস্তবায়ন না করেও সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন শাখায় ১৪ মাস সফটওয়্যার ব্যবহার করে ১৪০ মাসের ফি প্রদান করা হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকটির ব্যাখ্যা তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সারা দেশে ব্যাংকটির শাখা রয়েছে ৯৬০টি।
ব্যাংকের ১ হাজার ১৩৭টি কন্ট্রোল পয়েন্টে সিবিএস বাস্তবায়নের নির্দেশনা ছিল, তবে ব্যাংকটি মাত্র ৬৩৪ পয়েন্টে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। এরপরও অগ্রণী ব্যাংক জানিয়েছে, শতভাগ সিবিএস বাস্তবায়ন হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকটির ব্যাখ্যা তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ছাড়া স্বাক্ষর জাল করার জন্য ফ্লোরা টেলিকমের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া চুক্তি অনুযায়ী, সিবিএস বাস্তবায়ন ব্যর্থ হওয়ায় ফ্লোরা টেলিকম থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকটি পুরো কাজ না করে টাকা দিয়েছে। আবার মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এ জন্য জবাব চাওয়া হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।