কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি

ন্যাশনাল ব্যাংকে কী হচ্ছে

অনুমোদন ছাড়া ঋণ বিতরণ করছে ন্যাশনাল ব্যাংক। আবার মেয়াদ শেষ হলেও কাজ করে যাচ্ছেন চলতি দায়িত্বে থাকা এমডি।

ন্যাশনাল ব্যাংক
ন্যাশনাল ব্যাংক

অনুমোদন ছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের প্রস্তুতি নিয়ে কিছু ঋণ বিতরণও করেছে। আবার ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এ এস এম বুলবুলের মেয়াদ শেষ হলেও তিনি এমডি (চলতি দায়িত্বে) পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় গতকাল সোমবার অনুমোদন ছাড়া সব ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ঋণ বিতরণের অনুমোদন নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকেই।

ন্যাশনাল ব্যাংকের দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার গত ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কোনো পর্ষদ সভা না হলেও ঋণ বিতরণ ঠিকই অব্যাহত আছে বলে জানা গেছে। চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর মূলত তাঁর ছেলেরা ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন ব্যাংকটির কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাও। উল্লেখ্য, ন্যাশনাল ব্যাংক দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক, যার ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল সোমবার চিঠি দিয়ে ব্যাংকটির কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। আজ মঙ্গলবারের মধ্যে বিস্তারিত তথ্য জমা দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ নিয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি (চলতি দায়িত্বে) এ এস এম বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়াদ শেষ হলেও পরিচালনা পর্ষদ আমাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেছে। আগেও এমন হয়েছে। এতে কোনো সমস্যা নেই। পর্ষদ সভা হলেই আমার মেয়াদ বাড়বে। আর ঋণ দেওয়ার জন্য পর্ষদের কোনো সভা হয়নি, ঋণ বিতরণও হয়নি। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পেয়েছি, মঙ্গলবার জবাব পাঠানো হবে।’

চিঠিতে যা আছে

ন্যাশনাল ব্যাংকে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৬ ডিসেম্বরের পর অনুষ্ঠিত সব পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির সভার পূর্ণাঙ্গ কার্যবিবরণী জমা দিতে বলেছে। এ ছাড়া ২৬ ডিসেম্বরের পর সব ঋণ অনুমোদন ও বিতরণের বিস্তারিত তথ্য জমা দিতে হবে এবং এ সময়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত না হলে সব ঋণের অনুমোদন ও বিতরণ স্থগিত করতে হবে। চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল সোমবার ন্যাশনাল ব্যাংকে কর্মরত আছেন কি না, থাকলে তার সমর্থনে দলিলাদি সরবরাহ

করতে হবে। আর যদি তিনি কর্মরত না থাকেন, তাহলে তাঁকে ব্যাংকের সব দায়িত্ব থেকে বিরত রেখে ব্যাংকের সব নথিতে তাঁর প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে বলা হয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠিতে আরও বলেছে, রংধনু বিল্ডার্স, দেশ টিভি, রূপায়ন ও শান্তা এন্টারপ্রাইজের সব ঋণের নথিপত্র (ঋণ আবেদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত) এবং সব ঋণের পূর্ণাঙ্গ হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে।

ব্যাংকটিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত জানুয়ারির পর দিলকুশা শাখা থেকে রংধনু বিল্ডার্সকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে ব্যাংকটি। আর মহাখালী শাখা থেকে রূপায়ন ও দেশ টিভিকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। গুলশান করপোরেট শাখা থেকে ঋণ দেওয়া শান্তা এন্টারপ্রাইজকে। এর মধ্যে কিছু ঋণ বিতরণ হয়েছে, বাকি টাকা বিতরণের অপেক্ষায় আছে।

সিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ

২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদেরও বদল হয় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল)। ব্যাংকটির কর্তৃত্ব তখনই চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। এরপর অন্য সব পরিচালককে কৌশলে বের করে দেওয়া হয়। নিজের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের পর্ষদে যুক্ত করে ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ নেয় সিকদার পরিবার। এরপর থেকেই প্রথম প্রজন্মের এ ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮৮ কোটি টাকা, গত ডিসেম্বরে যা বেড়ে হয় ২ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকই সবচেয়ে বেশি অবলোপন করে আর্থিক স্থিতিপত্র থেকে খেলাপি ঋণ বাদ দিয়েছে। তারপরও কমাতে পারেনি খেলাপি ঋণ। অবলোপন করা এ ঋণ গত বছর ছিল ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটি একাধিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায় করতে না পারলেও তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে না। এতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র বের হচ্ছে না।

ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের যথাযথ মানে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। ন্যাশনাল ব্যাংক কয়েক বছরে ধরে তা রাখতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিলম্বে সঞ্চিতি রাখার সুযোগ দিয়ে ব্যাংকটিকে কাগুজে মুনাফা করার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরেও ব্যাংকটি সঞ্চিতি ঘাটতি ছিল ৪৩৫ কোটি টাকা।

আলোচনায় সিকদার গ্রুপের দুই পুত্র

এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গত বছরের ৭ মে গুলি করে আলোচনায় আসেন সিকদার গ্রুপের এমডি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রন হক সিকদার এবং তাঁর ভাই দিপু হক সিকদার। ১৯ মে এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা করলে ২৫ মে দুপুরে দুই ভাই রোগী সেজে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা ছেড়ে যান। নিজেদের মালিকানাধীন আরঅ্যান্ডআর এভিয়েশনের একটি উড়োজাহাজকে ‘রোগীবাহী’ হিসেবে দেখিয়ে তাঁরা ব্যাংককের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। পালিয়ে থাকা অবস্থায় জামিনের আবেদন করলে আদালত জরিমানাও করেছিলেন। জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর গত ১২ ফেব্রুয়ারি রন হক সিকদার দেশে এলে আটকের পর জামিন পান। এই জামিনের মেয়াদ ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে আরেক ভাই দিপু হক সিকদার এখনো পলাতক। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনো চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গতকালের চিঠি প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংকটি ভালো চলছিল না। নিয়মনীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যাংকটির কোনো সুনামও নেই। আরেকটি ব্যাংকের এমডিকে গুলি করাও ভালো ইঙ্গিত দেয় না। নিশ্চয়ই এর মাধ্যমে সরকার বুঝছে, পারিবারিক ব্যাংক হলে কী হয়। এ জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক নজর দিয়েছে। এটা ভালো হয়েছে। নিশ্চয়ই আরও ভালো কিছু সিদ্ধান্ত আসবে। যাতে ব্যাংকটি সঠিক পথে চলতে পারে।’