ঋণ কার্যক্রম খুলে দেওয়ার পর আবারও বড় অনিয়মের খোঁজ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকটির বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বড় অঙ্কের কোনো ঋণ দিতে পারবে না ন্যাশনাল ব্যাংক।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ অধিগ্রহণ করতে পারবে না।
শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ঋণ আদায়ের তথ্য দিতে হবে।
উপদেষ্টা, পরামর্শক ও এমডির দুই পদ নিচে কারও নিয়োগের অনুমোদন নিতে হবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ভল্টে আবার তালা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকটি বড় অঙ্কের কোনো ঋণ দিতে পারবে না। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম চালুর অনুমোদন দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আবারও বড় অনিয়মের খোঁজ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার চিঠি দিয়ে ব্যাংকটির বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে এবার আগের মতো ঋণ বিতরণ একেবারেই বন্ধ করে দেয়নি, বরং কী কী খাতে ঋণ দিতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে এসএমই খাতের ঋণ, কৃষি, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় দেওয়া ঋণ, জমা থাকা স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ, শতভাগ নগদ জমা দিয়ে ঋণপত্র ও অন্যান্য পরোক্ষ ঋণ (নন-ফান্ডেড) সুবিধা। তবে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ অধিগ্রহণ করতে পারবে না ন্যাশনাল ব্যাংক।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হচ্ছে ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মানেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এ জন্য আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের ৩ মে ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকটির জন্য বড় অঙ্কের ঋণ ও একক গ্রাহক ঋণসীমা নতুন করে নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার ঋণ আদায়ের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে বলা হয়। এর ফলে ব্যাংকটি কিছুদিন ভালো ছিল। কয়েকটি বড় গ্রুপের চাপে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর সেই নির্দেশনা তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর আবার একই অবস্থায় ফিরে যায় ব্যাংকটি। এ কারণে বৃহস্পতিবার নতুন করে আবার বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ গ্রাহকের মধ্যে অন্যতম হলো মায়শা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সাদ মুসা, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, এফএমসি ডকইয়ার্ড, প্রাণ-আরএফএল, ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট। ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল হলো একটি গ্রুপের বেনামি ঋণ। আর আগে এস আলম গ্রুপ ছিল শীর্ষ ঋণগ্রহীতা। এস আলম গ্রুপের সব সুদ মওকুফ করায় আসল টাকা ফেরত দিয়েছে গ্রুপটি।
জানা গেছে, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ঋণ কার্যক্রম খুলে দেওয়ার পর ব্যাংকটি ফু-ওয়াং সিরামিক ও এসএস স্টিলকে ৮০০ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দেয়। দুটি প্রতিষ্ঠানই এক ব্যক্তির মালিকানাধীন। এই প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট সালেহ স্টিলকে দেড় শ কোটি টাকা অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা পর্ষদ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ঋণ প্রস্তাব আটকে দেয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যাংকটির একজন পরিচালকের সখ্য রয়েছে। এ কারণে অল্প সময়ে বড় অঙ্কের অর্থায়ন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে ব্যাংকটিকে সতর্ক করে। ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ডেকে সভা করে। এরপরও একই ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় ঋণ কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে, ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ঋণ আদায়ের তথ্য প্রতি মাসে জমা দিতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকের উপদেষ্টা, পরামর্শকসহ এমডির দুই পদ নিচে কারও পুনর্নিয়োগ অথবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে।
জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি মেহমুদ হোসেন গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত আমরা পেয়েছি। ব্যাংকের সূচকে উন্নতি ঘটছে। এরপরও কেন এমন সিদ্ধান্ত এল, তা বুঝতে পারছি না।’
বেনামি ঋণ ঠেকাতে গত বছরের ৩ মে ঋণ বন্ধের পাশাপাশি সব মিলিয়ে ছয় ধরনের শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। ফলে আমানত সংগ্রহ, ঋণ আদায় ছাড়া ব্যাংকটির আর কোনো কার্যক্রম ছিল না। এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমানত পায় ব্যাংকটি। ফলে ব্যাংকটির আমানত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে।
গত এপ্রিল শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ও ঋণ ছিল ৩৯ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। বিদায়ী বছরে ব্যাংকটি ৩৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা ছাড় নিতে হয়। এই কারণে গত বছরের জন্য শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি ব্যাংকটি। অথচ ন্যাশনাল ব্যাংক একসময় দেশের পুরো ব্যাংক খাতের শীর্ষ তিন মুনাফা অর্জনকারী ব্যাংকের একটি ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকটি কোনোভাবেই নিয়মকানুনের মধ্যে আসছে না। এ জন্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর আবারও নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়েছে।
এর আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে শেষ মুহূর্তে বেসিক ব্যাংক ও সাবেক ফারমার্স (এখন পদ্মা) ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঋণ বন্ধ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক দুটিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়ে একই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছে না।
২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদেরও বদল হয় ন্যাশনাল ব্যাংকের। ব্যাংকটির কর্তৃত্ব তখনই চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। এর পর থেকেই প্রথম প্রজন্মের এ ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার।