সরকারের বর্তমান মেয়াদে এসে অর্থ মন্ত্রণালয় এখন সরাসরি বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিচ্ছে। বিভিন্ন সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছে।
দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার পুরো দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ জন্য ব্যাংক খাত নিয়ে সরকারও লিখিতভাবে কোনো নির্দেশনা দেয় না—শুরু থেকে এমনটাই চলে আসছে। তবে সরকারের বর্তমান মেয়াদে এসে অর্থ মন্ত্রণালয় এখন সরাসরি বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিচ্ছে। বিভিন্ন সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছে। আর এসব সিদ্ধান্ত যাচ্ছে ব্যাংক খাতের আমানতকারীদের বিরুদ্ধে। এতে দুর্বল হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর ঝুঁকিতে পড়ছে পুরো খাত।
গত এক দশকে সরকারের ইচ্ছায় ও পরামর্শে নতুন ব্যাংক অনুমোদন, ঋণখেলাপিদের ছাড় ও সুবিধা দেওয়া, ঋণের সুদহার নির্দিষ্ট করে দেওয়াসহ নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এসব নির্দেশ ও পরামর্শ বেশির ভাগ এসেছে মৌখিকভাবে বা কোনো অনানুষ্ঠানিক সভায়। এখন নির্দিষ্ট একটি গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা দিতে লিখিত নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আর শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বাড়তি টাকা ঢালতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডেকে সভা করেছে, নির্দেশনা দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদপ্তরে পরিণত হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনা দিতে পারে না মন্ত্রণালয়।মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো অধিদপ্তরে পরিণত হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মন্ত্রণালয় কোনো নির্দেশনা দিতে পারে না। যেদিন হোটেলে বসে সিআরআর কমানোসহ নানা সিদ্ধান্ত হয়েছে (২০১৮ সালে), সেদিন থেকে এই প্রথা চালু হয়েছে।’
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ‘আমাদের সময়ে এটা চিন্তাও করা যেত না। মন্ত্রণালয় জানত এমন নির্দেশনা পালন করা হবে না। ব্যাংক খাত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভালো জ্ঞান আছে, তাই ব্যাংক খাত নিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। নচেৎ খাতটির ক্ষতি হয়।’ ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত গভর্নর ছিলেন তিনি।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেসরকারি ব্যাংক নজরদারি ও তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। অন্যদিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো তদারকির জন্য ২০১০ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নতুন করে তৈরি করা হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, এখন যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অথচ ১৯৯৪ সালে বিএনপি আমলে শুরু হওয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগ ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারই বাতিল করে দিয়েছিল। এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ শুধু সরকারি ব্যাংক নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও তদারক করতে শুরু করেছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা দিন দিন কমছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী ও ব্যাংকমালিকদের হস্তক্ষেপও চলছে। পাশাপাশি অর্পিত ক্ষমতার চর্চা নিজেরাও কমিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।
২০২০ সালের শুরুতে শেয়ারবাজার টালমাটাল হয়ে পড়ে। এ সময় শেয়ারবাজারে পতন ঠেকাতে অর্থমন্ত্রী, বিএসইসি, গভর্নরসহ বিভিন্ন পক্ষ দফায় দফায় সভা করে। শেষ পর্যন্ত পতন ঠেকানোর দায়িত্ব গিয়ে পড়ে ব্যাংকগুলোর ওপর। আইনি সীমার বাইরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য নতুন তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক কোম্পানি আইনের বাইরে বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ২০০ কোটি টাকা তহবিল গঠনের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যার মেয়াদ দেওয়া হয় পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পাশাপাশি এই অর্থ কোন খাতে খাটাতে পারবে, তা–ও নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরপর ২০২১ সালের ২৩ জুন একটি কোম্পানিকে (বেক্সিমকো লিমিটেড) গ্রিন সুকুক বন্ড ছেড়ে তিন হাজার কোটি টাকা তোলার অনুমোদন দেয় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এই অর্থের ৭০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পে বিনিয়োগ হবে, যার মেয়াদ দেওয়া হয় পাঁচ বছর।
২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব নাহিদ হোসেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে এক নির্দেশনা প্রদান করেন। এতে বলা হয়, ‘শেয়ারবাজারে গ্রিন সুকুক বন্ডে বিনিয়োগের শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা থেকে অব্যাহতি অথবা বিনিয়োগ সীমা শিথিলের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে বিবেচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা হলো।’ এর মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা তহবিলের পুরোটাই গ্রিন সুকুক বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই দিন নতুন করে আগের নির্দেশনা সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। যেখানে তহবিলের পুরো টাকা গ্রিন সুকুকে বিনিয়োগ করতে পারার সুযোগ দেওয়া হয়, তহবিলের মেয়াদও বাড়ানো হয়। এতে এক দিনেই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ নিয়ে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের চিঠি এলেও আর্থসামাজিক বিষয় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
নিজে উদ্যোগী হয়ে সমস্যা ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানাতে হবে।সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর
বিভিন্ন সূত্র জানায়, শেয়ারবাজারে সূচকের উত্থান-পতনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ জানুয়ারি অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে একটি অনির্ধারিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের, বিএসইসির কমিশনার শেখ সামসুদ্দিন আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন।
এতে কয়েকটি বিষয়ে সুপারিশ গ্রহণ করা, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হয় দুটি দায়িত্ব। যেমন ব্যাংক শেয়ারবাজারে যে বিনিয়োগ করে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬ক ধারায় ‘বাজারমূল্য’-এর সংজ্ঞা পর্যালোচনা এবং এ জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতামত গ্রহণ করা।
বর্তমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংক অন্য কোনো কোম্পানির যে শেয়ার ধারণ করবে, তার শেয়ারের মূল্য ওই সময়কার বাজারমূল্যে হিসাব করা হয়। তবে এই হিসাব বাজারমূল্যে না ক্রয়মূল্যে হবে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মুখোমুখি অবস্থানে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। এ ছাড়া শেয়ারবাজারের জন্য ব্যাংকগুলোর ২০০ কোটি টাকা তহবিল বিনিয়োগকে সীমার বাইরে রাখার বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতামত গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয় ওই সভায়। তবে গভর্নর ফজলে কবির এই দুই সুপারিশই নাকচ করে দেন এবং জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রয়োজন মনে করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ নিতে পারে। যেসব ব্যাংক তালিকাভুক্ত হয়নি, তাদের আর সময় না দেওয়ার কথা বলা হয়।
ওই সভায় অর্থসচিব নির্দেশ দেন, সভার সুপারিশগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য কেউ মন্ত্রণালয়ের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এখন ডেপুটি গভর্নরদের ডেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতেই ব্যাহত হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণ।
২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিন সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, এমন নির্দেশনা ভালো লক্ষণ না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতায় আঘাত। এর ফলে পুরো ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বসে থাকলে চলবে না। নিজে উদ্যোগী হয়ে সমস্যা ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানাতে হবে।