শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ‘বিনিয়োগ’ নিয়ে গত মঙ্গলবার এক নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে পুঁজিবাজারের কোন কোন উপাদানে বিনিয়োগকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ’ হিসেবে গণ্য করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ বিষয়ে আগে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল না। তাই বিষয়টি স্পষ্টীকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ ধরনের নির্দেশনা আগে থেকেই ছিল। এখন তা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট করা হলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনার ফলে আবার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এ নির্দেশনার ফলে ‘উদীয়মান বন্ড’ বাজারটি আবার মার খেতে পারে। কারণ, করপোরেট বন্ডকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসাবের মধ্যে যুক্ত করা হয়েছে। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে। পাশাপাশি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি ব্রোকারেজ হাউস বা পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানকে গাড়ি কেনা বা ব্যবসা সম্প্রসারণ বা দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে কোনো ঋণও দেয়, সেটিও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হবে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ব্রোকারেজ হাউসকে গাড়ি কেনা বা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ দিলে সেটি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা কতটা যৌক্তিক?
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে নিরুত্তাপ বন্ড বাজারে কিছুটা গতি ফিরতে শুরু করেছে। বড় বড় বেশ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণের বদলে করপোরেট বন্ড ছেড়ে ব্যবসার পুঁজি সংগ্রহ করেছে। আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ড ছাড়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব বন্ডের ক্রেতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু করপোরেট বন্ডে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হচ্ছে। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে।
বর্তমানে বন্ড নিয়ে কাজ করছেন ও দেশের এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক শীর্ষ নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যখনই আমরা করপোরেট বন্ড নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যাচ্ছি, তখনই তারা বলছে, “আমরা ঋণ দিতে রাজি আছি।” কিন্তু বন্ডে বিনিয়োগে তারা খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কারণ হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা বলছেন, বন্ডে নতুন করে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করলে তাঁদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ-নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করবে। তাতে হয়তো শেয়ারবাজারের অন্যান্য বিনিয়োগ কমাতে হবে।’
এ কারণে বন্ডে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ বা এক্সপোজারের বাইরে রাখার দাবি উঠেছে। বন্ড বাজার নিয়ে কাজ করছে, এমন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ দাবি এরই মধ্যে তুলে ধরেছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি হচ্ছে, বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিয়ে সেই ঋণ আদায় করতে না পারলে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু বন্ডের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ সীমিত। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সুরক্ষার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ যুক্তিরও গ্রহণযোগ্যতা আছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কী বন্ড বাজার গড়ে উঠবে না দেশে? সাধারণ মানুষের কাছে এখনো বন্ড বিনিয়োগের জন্য খুব বেশি জনপ্রিয় উপাদান হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। তাই সাধারণ মানুষের ওপর ভরসা করে বন্ড বাজারের খুব বেশি উন্নতি করার বাস্তবতা এখনো তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে আগে। তবে অবশ্যই সেটি বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিত করে। আর সেই বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে আর্থিক খাতের সব নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিতভাবে। সেখানেই সবচেয়ে বড় ঘাটতি রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে। আবার শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের নতুন নতুন নানা পণ্য চালু করার পাশাপাশি বাজারকে বড় করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয়ের বড় ঘাটতি। আর সেই সমন্বয়হীনতা থেকে নানা ধরনের সমস্যার উদ্ভব। তার ভুক্তভোগী যেমন হচ্ছেন শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারী, তেমনি পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান। ফলে ঘুরেফিরে স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের বড় উৎস হয়ে থাকছে ব্যাংক। শেয়ারবাজারসহ বিকল্প অর্থায়নের বৈশ্বিক ব্যবস্থাগুলো এ দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংক খাত বা শেয়ারবাজারে নানা কেলেঙ্কারির জন্ম হচ্ছে।