দুই দশকের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে গত বছর। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এসব অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে।
২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা।
গত ২০২০ সালে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ এক লাফে এক বছরে ৫৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার তথ্যটি এমন একসময়ে এসেছে, যখন সরকারের পক্ষ থেকে নামমাত্র কর দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৯ জুন প্রস্তাবিত ২০২২–২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছেন। এ নিয়ে দেশের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিা—সবাই সরকারের এ উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করছেন বাজেট ঘোষণার পর থেকে। তবে ১০ জুন বাজেট–উত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে। আর এ কারণেই তা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ এসব অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বাধা না দেওয়ার আহ্বানও জানান অর্থমন্ত্রী। ওই একই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির দাবি করেছিলেন, ‘সুইস ব্যাংকসহ (সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক) বিভিন্ন দেশে যে অর্থ গেছে, তা বাংলাদেশ থেকে যায়নি।’
এদিকে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। তাতে গত দুই দশকের মধ্যে গত বছরই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমার রেকর্ড হয়েছে। ২০০০ সালে সুইস ব্যাংকে জমা বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৯৩ কোটি টাকা।
২০২১ সালে এসে সেটি বেড়ে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থ প্রথমবারের মতো ৫০ কোটি সুইস ফ্রাঁ অতিক্রম করেছে ২০১৪ সালে। এরপর সাত বছরের মধ্যে চার বছরই সেখানে জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। গত ২০১৯ ও ২০২০ সালে পরপর দুই বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ কমেছিল। কিন্তু গত বছর এসে তা ৫৫ শতাংশ বেড়ে যায়।
বিদেশে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ। বর্তমানে এ ইউনিটের প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস। এ বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে ২০২১ সালে বিএফআইইউর প্রধান ছিলেন আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। জানতে চাইলে তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে যে অর্থের তথ্য প্রকাশ করা হয়, সেই অর্থ বাংলাদেশ থেকে গেছে এমনটা বলা যাবে না। অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে থাকেন, তাঁদের টাকাও সে দেশের ব্যাংকে জমা থাকতে পারে। এ জন্য সব পাচারের টাকা, এমন মনে করা ঠিক হবে না। তবে দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে কাজ করছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিএফআইইউ।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জমা হওয়া অর্থকে দায় হিসেবে দেখানো হয়েছে। ‘দায়’ হিসেবে দেখানো মানে হচ্ছে এ অর্থ গ্রাহক চাইলে ফেরত দিতে হবে।
শুধু বাংলাদেশি নয়, ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমানো অর্থের পরিমাণও বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৮৩ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৬ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে ভারতীয়দের অর্থের পরিমাণ ছিল ২৫৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ২৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
সুইস ব্যাংকে অর্থ জমার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য হচ্ছে, সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের যে হিসাব দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেয়, তার সব অর্থ যে পাচারের অর্থ, তা নয়। বৈধভাবেও দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিরা অর্থ জমা রাখেন। বিশেষ করে সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা বিভিন্ন দেশে অর্থ রাখেন। বিদেশ বসবাস করলেও বাংলাদেশি পরিচয় ব্যবহার করে যখন সেখানকার কোনো ব্যাংকে অর্থ রাখা হয়, তখন তা বাংলাদেশির অর্থ হিসেবে গণনায় ধরা হয়। তবে অবৈধভাবেও দেশটিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়।
এদিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ গত দুই দশক ধরে বেড়ে চললেও এসব অর্থ দেশে ফেরত আনা বা এসব অর্থের মালিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। এবারই বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে করছাড় বা করের ডিসকাউন্ট সুবিধা দিয়ে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা ও তথ্য–উপাত্ত থেকে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যায়। আগে বাণিজ্যের আড়ালে বাণিজ্য পুঁজি পাচার হতো।
এখন আর্থিক পুঁজি পাচার হচ্ছে। আর এ কাজের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতি চক্রের আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে। পাশাপাশি সরকারি নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। এ কারণে পাচারের অর্থ নামমাত্র করে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাজেটীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়। বলা চলে, দুর্নীতির আন্তর্জাতিকীকরণ চক্রের হাতে এখন নীতিও ছিনতাই হয়ে গেছে।’