আমানত বেশি, ঋণ কম

অতিরিক্ত টাকার চাপে ব্যাংক

  • টাকা রাখার জন্য ব্যাংকের বিকল্প ভালো কিছু তেমন নেই। এ জন্য বাড়ছে আমানত। তবে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করছে না।

  • গত আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা।

  • এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ আছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

ঋণের সুদ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় আমানতের সুদও ৬ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। নিশ্চিত মুনাফা ও নিরাপদে টাকা ফেরতের আশায় এরপরও কিছু ব্যাংকে আমানতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কারণ, মানুষের হাতে টাকা রাখার জন্য ভালো বিকল্প নেই। তবে এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করছে না। এতে ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।

ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে চাহিদামতো সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড, কল মানি ও অন্য ব্যাংকে আমানত হিসেবেও রাখতে পারছে না। এতে জমা টাকা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেছে কিছু ব্যাংক।

গত আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ আছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা বিনিয়োগ করেছে ট্রেজারি বিল-বন্ড ও বৈদেশিক মুদ্রায়।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার মধ্যেও ভালো আমানত ও নগদ জমার হার (সিআরআর) কমানোয় ব্যাংকগুলোর হাতে তারল্য বেড়েছে। এর বিপরীতে কমে গেছে ব্যক্তি খাতের ঋণ, সরকারও ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। কমে গেছে ট্রেজারি বিল-বন্ডের বিপরীতে আয়ের পরিমাণ। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণ দিতেও সতর্ক হয়ে গেছে কিছু ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোতে গত ফেব্রুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ব্যাংকগুলো থেকে আমানত উত্তোলনের চাপ বেড়ে গেলে মার্চ শেষ অতিরিক্ত তারল্য কমে হয় ৮৯ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আগে থেকে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে নানা সমস্যা ছিল, করোনাভাইরাসের কারণে তা আরও বেড়েছে। এ জন্য ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ না করে সরকারি বিল-বন্ডে টাকা খাটাচ্ছে। ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইছে না। আবার ৯ শতাংশ সুদের কারণে এসএমই খাত ঋণ পাচ্ছে না। ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ তৈরি করতে হবে।

এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, জাপানসহ কিছু দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখলে ব্যাংকগুলোকে মাশুল গুনতে হতে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেশি জমা রাখলে একইভাবে মাশুল আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তা খুঁজে ঋণ দিতে শুরু করবে।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলোতে গত ফেব্রুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ব্যাংকগুলো থেকে আমানত উত্তোলনের চাপ বেড়ে গেলে মার্চ শেষ অতিরিক্ত তারল্য কমে হয় ৮৯ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ১ এপ্রিল থেকে কমানো হয় ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর)। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা ফেরত পায় ব্যাংকগুলো। এতে এপ্রিল শেষে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে হয় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে যা আরও বেড়ে হয় ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা ও আগস্টে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা।

আমরা ইসলামি বিনিয়োগ বন্ড ও অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিচ্ছি। প্রণোদনার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করব। আশা করছি, এর মাধ্যমে অতিরিক্ত তারল্য কমে আসবে। চলতি বছরে এভাবে চলুক, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহবুল-উল-আলম

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৬০ কোটি ডলার ক্রয় করে। প্রবাসী আয়ের কারণে ব্যাংকগুলোর ডলার ধারণের সীমা অতিক্রম করায় ডলার কিনে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কাছে নগদে ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা জমা হয়।

জানা গেছে, গত জুলাইয়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, এবং ঋণে প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। ভাইরাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে কম সুদের প্রণোদনা প্যাকেজের কারণে ঋণ বাড়তে শুরু করেছে।

এরপরও অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে বিপাকে আছে কিছু ব্যাংক। গত আগস্ট শেষে সোনালী ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য ৩৫ হাজার ২২ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ১১ হাজার ২২৮ কোটি ও ইসলামী ব্যাংকের ৯ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহবুল-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইসলামি বিনিয়োগ বন্ড ও অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিচ্ছি। প্রণোদনার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করব। আশা করছি, এর মাধ্যমে অতিরিক্ত তারল্য কমে আসবে। চলতি বছরে এভাবে চলুক, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’

অতিরিক্ত টাকা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি, কোথায় খাটাব খুঁজে পাচ্ছি না। কল মানিতে সুদ ১ শতাংশ, অন্য ব্যাংকে রাখলে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ। আশা করছি এসএমই ও খুচরা ঋণের চাহিদা বাড়বে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন

এর বাইরে পূবালী ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য ৮ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা।

এ নিয়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি, কোথায় খাটাব খুঁজে পাচ্ছি না। কল মানিতে সুদ ১ শতাংশ, অন্য ব্যাংকে রাখলে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ। আশা করছি এসএমই ও খুচরা ঋণের চাহিদা বাড়বে। রপ্তানি বাড়ছে, অন্য ঋণও বাড়বে। এর ফলে আমাদের বিনিয়োগ বাড়বে। এর মাধ্যমে সমস্যা কেটে যাবে।’

তবে তারল্য নিয়ে সব ব্যাংকের পরিস্থিতি এক না। অনেক ব্যাংক টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। গ্রাহক থেকে আমানত না পেয়ে বেশি সুদে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিচ্ছে।