টিকে থাকার জন্য ব্যাংকটি বড় অঙ্কের ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর বা কোনো সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
সংকটে পড়া বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংককে (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো, যা ব্যাংকটির মূলধনের ৬৬ শতাংশ। এরপরও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের জমা টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি।
এসব আমানত ফেরত দিতে আগামী ২০২৯ সাল পর্যন্ত সময় চাইছে। আর বেঁচে থাকতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করতে চাইছে। এটা সম্ভব না হলে সরকারি যেকোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় পদ্মা ব্যাংক।
পদ্মা ব্যাংক আমেরিকা থেকে তহবিল আনতে চায়। ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে এটাই ভালো পথ।মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম, পরিচালক পদ্মা ব্যাংক ও এমডি, অগ্রণী ব্যাংক।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসান খসরু গত ৮ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে অভিনব এই প্রস্তাব দেন। পদ্মা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন সরকারি চার ব্যাংক ও আইসিবির এমডি।
এ নিয়ে সোনালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদে একীভূত হওয়া নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কেন এমন প্রস্তাব দিল, জানি না।’
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি নুরুল আমিন বলেন, ‘কেন একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে সরকারি ব্যাংক গ্রহণ করবে? দুই পক্ষের লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেই একীভূত হওয়ার প্রশ্ন আসতে পারে। এ জন্য ভালো কোনো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুর্বল প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা করাতে হবে।’
দুই পক্ষের লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেই একীভূত হওয়ার প্রশ্ন আসতে পারে। এ জন্য ভালো কোনো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুর্বল প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা করাতে হবে।নুরুল আমিন, সাবেক সভাপতি, এবিবি
ফারমার্স ব্যাংক নাম থাকাকালে ঋণ বিতরণে নানা অনিয়মের কারণে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে। সরকারের উদ্যোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মিলে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধনের জোগান দেয়। এরপর এটির নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে পদ্মা ব্যাংকের এমডি বলেন, ‘২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্গঠিত হয়। এরপর গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে দুই বছরের মধ্যে তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে এবং ধীরে ধীরে গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসছে। তবে করোনার কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংকুচিত হওয়ায় আমাদের ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ কমে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ঋণ আদায়ের গতি তীব্রতর করতে না পারায় লোকসান ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ফলে মূলধন লক্ষণীয়ভাবে কমছে। গত জুনে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। ২০২০ সালে ব্যাংক পরিচালনায় ২০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে সচিবের কাছে দুই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন এর এমডি। প্রথমত, সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের একটি অংশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শেয়ারে রূপান্তর করা। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকটির ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততার জন্য প্রয়োজন ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে অগ্রাধিকার শেয়ার ইস্যু ও ৬০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত সাব–অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু করা।
চিঠিতে পদ্মা ব্যাংকের এমডি এহসান খসরু বলেন, পদ্মা ব্যাংককে দ্রুত সময়ে সোনালী, জনতা, অগ্রণী বা রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। এর বাইরে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) সঙ্গেও একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
এদিকে পদ্মা ব্যাংকের এমডি এহসান খসরুর মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত নেওয়া হয়। এই প্রস্তাবে তা নেওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।
জানা গেছে, ব্যাংকটি এখন ক্ষুদ্র আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে পারলেও প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এমন আমানতের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি জীবন বীমা করপোরেশনের টাকা ফেরত দিতে ২০২৯ সাল পর্যন্ত সময় চেয়েছে ব্যাংকটি। ব্যাংকটি বড় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ফেরত দিতে না পেরে এখন সুদ দিচ্ছে।
পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একীভূত হওয়া নিয়ে কোনো বিষয় জানি না। পদ্মা ব্যাংক আমেরিকা থেকে তহবিল আনতে চায়। ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে এটাই ভালো পথ।’
২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘একটা ভুল করেছি আমি। ফারমার্স ব্যাংককে স্বাভাবিকভাবে মরতে দেওয়া উচিত ছিল।’