একটি ঋণ অনুমোদনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত পর্যবেক্ষককে কথা না বলার নির্দেশ দেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত পর্যবেক্ষক লীলা রশিদকে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয় না। কথা বলার সময় তাঁকে আটকে দেওয়া হয় এবং তাঁর সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জায়েদ বখতের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখতের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন ব্যাংকটির পর্যবেক্ষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক লীলা রশিদ।
গভর্নরের তাৎক্ষণিক নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে কমিটি। সে অনুযায়ী জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এরপর দুই মাস চলে গেলেও অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বা বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়কেও জানায়নি।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি আগস্ট মাসের ঘটনা। এখন তো অক্টোবরও শেষ। ঘটনার সত্যতা পেলে নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু জানাত। পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হলে নিত। কিন্তু আমাকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।’
জায়েদ বখত আরও বলেন, ‘পর্ষদে সবাই মতামত তুলে ধরে। তাই ভিন্নমত আসতেই পারে। তবে সবার মতামতের ভিত্তিতে ঋণ অনুমোদন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।’
২০১৪ সাল থেকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন জায়েদ বখত। তিনি অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদে নিয়োগ কমিটিরও একজন সদস্য।
গত ১৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত অগ্রণী ব্যাংকের পর্ষদের ৬৭৭তম সভার সূত্র ধরেই জায়েদ বখতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন লীলা রশিদ। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত শুরু করে ১৮ আগস্ট। জানা গেছে, অনলাইনে অনুষ্ঠিত অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওই সভায় আফিয়া সিএনজি ফিলিং স্টেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এক কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব আলোচনায় ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারিদের (সিএমএসএমই) প্রণোদনা তহবিলের আওতায় এই ঋণ প্রদানের প্রস্তাব তোলা হয়। কিন্তু সভায় উপস্থিত ছয় পরিচালকের মধ্যে তিনজন ঋণ না দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। তারপরও ঋণটি যখন অনুমোদিত হচ্ছিল, তখন এ নিয়ে পর্যবেক্ষক কথা বলতে চাইলে তাঁকে থামিয়ে দেন জায়েদ বখত। সভার পরদিন ১৮ আগস্ট গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেন লীলা রশিদ। অভিযোগে ঘটনার উল্লেখ করে লীলা রশিদ জানান, বিগত দুই মাসের বিভিন্ন সভায় তিনি লক্ষ করেছেন, প্রায়ই অন্য সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে চেয়ারম্যান নিজের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছেন।
সভার ভিডিও পর্যবেক্ষণ করে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্রণী ব্যাংকে নগদ অর্থের প্রবাহ ঋণাত্মক থাকায় ঋণটি মঞ্জুরের বিপক্ষে অবস্থান নেন পরিচালক ফরজ আলী। তাঁকে সমর্থন করেন আরেক পরিচালক কাশেম হুমায়ুন এবং তিনিও ঋণ মঞ্জুরের বিপক্ষে অবস্থান নেন।
এই পর্যায়ে পর্যবেক্ষক লীলা রশিদ বলেন, এসএমই প্রতিষ্ঠানের জন্য এক কোটি টাকা ঋণ হচ্ছে প্রণোদনার সর্বোচ্চ সীমা। তা ছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থের প্রবাহ তিন বছর ধরে ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে পরিচালক মাহমুদা বেগম ঋণ প্রদানের পক্ষে মত দেন। পরিচালক খন্দকার ফজলে রশিদ নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও ঋণ এক কোটি টাকার কম দেওয়া যায় কি না, তা বিবেচনার প্রস্তাব রাখেন। এ সময় চেয়ারম্যান ৮০ লাখ টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখন পর্যবেক্ষক দ্বিধাবিভক্তির কথা উল্লেখ করে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি লীলা রশিদকে থামিয়ে দেন ও সীমা অতিক্রম না করার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া তিনি ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতির বিষয় ছাড়া কোনো বিষয়ে কথা না বলা এবং তাঁর ওপর রুলিং না দেওয়ার জন্য বলেন। প্রায় দেড় মিনিটের এই বাক্যবিনিময় যথেষ্ট অপ্রীতিকর ছিল।
এটি আগস্ট মাসের ঘটনা। এখন তো অক্টোবরও শেষ। ঘটনার সত্যতা পেলে নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু জানাত। পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হলে নিত। কিন্তু আমাকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।জায়েদ বখত, চেয়ারম্যান, অগ্রণী ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত দল প্রতিবেদনে বলেছে, ঋণ মঞ্জুরের সময় সবার মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়েই চেয়ারম্যান ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তও হয়েছে। এর পরে কী হয়েছে, সেটা জানি না।’