মিরপুরে এখন বাণিজ্যের বড় সম্ভাবনা দেখছেন বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা। এ জন্য অনেকে ওই এলাকায় নতুন করে বিক্রয়কেন্দ্র চালু করছেন। আর পুরোনোরাও ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন।
রাজধানীর উত্তরায় নারীদের পোশাক বিক্রি করে ফাস্ট ভ্যালু বিডি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের পাশেই একটি নির্মাণাধীন ভবনে নতুন করে জায়গা ভাড়া নিয়েছে বিক্রয়কেন্দ্র খোলার জন্য। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বিক্রয়কেন্দ্রটি চালু হওয়ার কথা। ফাস্ট ভ্যালু বিডির স্বত্বাধিকারী খুশি আক্তার বলেন, ‘মেট্রোরেল চালু হওয়ায় উত্তরা বা মতিঝিল থেকে মিরপুর যাতায়াত এখন সহজ হয়েছে। তাতে মিরপুরের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও বেড়েছে। এই দুই কারণে মিরপুরে নতুন বিক্রয়কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’
মেট্রোরেল পুরোদমে চালু হওয়ায় খুশি আক্তারের মতো অনেকেই এখন মিরপুরে ব্যবসার বড় সম্ভাবনা দেখছেন। ফলে জনবহুল এ এলাকায় বাড়ছে বিভিন্ন খাতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। সম্প্রতি মিরপুর এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নতুন অনেক ব্র্যান্ড ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যেমন এসেছে, তেমনি পুরোনোরাও তাঁদের ব্যবসার পরিসর বড় করছেন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে এখানকার আবাসন খাতেও।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় মিরপুরে অন্যান্য এলাকার মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। তবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চাঙা থাকলে আরও ভালো প্রবৃদ্ধি হবে বলে জানান তাঁরা।
দুর্ভোগ কাটিয়ে স্বস্তি
রাজধানীর উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের (এমআরটি লাইন-৬) প্রথম পর্যায়ের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এরপর বেহাল সড়ক, ধুলাবালু, যানজট ও জলাবদ্ধতা মিলিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় মিরপুর এলাকা ছিল অনেকের কাছে দুর্ভোগের অপর নাম। জনদুর্ভোগের পাশাপাশি এই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্থবিরতা নেমে এসেছিল। পাঁচ বছরের বেশি সময় নির্মাণকাজ শেষে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও এবং গত ৪ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে মেট্রোরেল চালু হয়।
দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণকাজের কারণে দিন-রাত মিরপুরের প্রধান সড়কে যানজট লেগেই থাকত। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানে দিনের পর দিন ক্রেতার দেখা মেলেনি। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান লোকসানে কোনোমতে টিকে ছিল ব্যবসায়। আবার কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। সেই চিত্র এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে।
মিরপুর এখন ‘বড় বাণিজ্যকেন্দ্র’
বিভিন্ন খাতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতানের পাশাপাশি মিরপুরে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের খেলার মাঠ (স্টেডিয়াম), সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কার্যালয় ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র, আবাসিক এলাকা ও একাধিক বড় হাসপাতাল। ফলে আগে থেকেই জনবহুল এ এলাকার বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় সেই গুরুত্ব আরও বেড়েছে। গত তিন-চার বছরে এই এলাকায় চালু হয়েছে নামীদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রায় অর্ধশত বিক্রয়কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, সুপারমার্কেট প্রভৃতি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিরপুর এখন রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
রাজধানীর আগারগাঁও থেকে মিরপুর-১০ নম্বরের দিকে এগোলে রাস্তার দুই পাশে বাণিজ্যিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো চোখে পড়ে। যেমন শেওড়াপাড়া স্টেশনের ঠিক আগেই সম্প্রতি চালু হয়েছে খাবারের দোকান ডোমিনোজ পিৎজার নতুন বিক্রয়কেন্দ্র। শেওড়াপাড়া স্টেশন পার হতেই দেখা মিলবে ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ড ভিশনের নতুন বিক্রয়কেন্দ্র। এভাবে মিরপুর-১০ নম্বর পর্যন্ত সড়কে গত এক বছরে বিভিন্ন খাতের অনেকগুলো নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করেছে।
মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের ঠিক পাশেই এফএস টাওয়ার নামে ১৭ তলা একটি বাণিজ্যিক ভবনের কাজ চলছে। আশপাশের এলাকার মধ্যে এটিই এখন সবচেয়ে উঁচু ভবন। ইতিমধ্যে ভবনটির দ্বিতীয় থেকে সপ্তম তলার অনেক জায়গা ভাড়া হয়ে গেছে। ভবনটির বিক্রয় ও বিপণন ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুন চৌধুরী জানান, স্থানগত সুবিধা ও মেট্রোরেলের কারণে তাঁদের ভবনের চাহিদা অনেক বেশি।
মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের আশপাশে বেশ কিছু নতুন পোশাক ও জুতার ব্র্যান্ড এসেছে। এ রকমই একটি পোশাকের ব্র্যান্ড আর্ট। আর্টের শাখা ব্যবস্থাপক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘গ্রাহক চাহিদা থাকায় মেট্রোরেল চালুর পরে এখানে বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেছি। ইতিমধ্যে ভালো সাড়াও পাচ্ছি।’
মিরপুরের ব্যস্ত এই এলাকায় রয়েছে সুলতান’স ডাইনসহ কয়েকটি বড় রেস্তোরাঁও। একাধিক রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপকেরা জানান, মেট্রোরেল চালুর পর গত এক বছরে তাঁদের বেচাবিক্রি বেড়েছে ৫-১০ শতাংশ।
ব্যবসা বড় হচ্ছে
নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পুরোনো অনেক প্রতিষ্ঠান মিরপুরে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ বা বড় করছে। এ রকমই একটি শিশুদের ইনডোর খেলাধুলার প্রতিষ্ঠান বাবুল্যান্ড। গত বছর মিরপুর-১২ ও শেওড়াপাড়ায় দুটি শাখা চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাবুল্যান্ডের চেয়ারম্যান ইশনাদ চৌধুরী জানান, তাঁদের মিরপুরের শাখাগুলোতে প্রায় ১০ শতাংশ সেবাগ্রহীতা আসেন মেট্রোরেলে চড়ে। এমনকি মতিঝিল এলাকা থেকেও মিরপুরের বাবুল্যান্ডে অনেকে আসছেন।
ব্যবসা সম্প্রসারণের তালিকায় রয়েছে বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও। যেমন মিঠাই, টেস্টিট্রিট, ডেইলিশপিং, বেস্টবাই, ভিশন ও রিগ্যালসহ প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মেট্রোরেলকেন্দ্রিক প্রায় ৪০টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয়েছে গত এক বছরে।
সম্প্রতি সরেজমিনে মিরপুর-১১ মেট্রো স্টেশন থেকে পল্লবীর দিকে যেতে দেখা গেল, এই সড়কের দুই পাশে ইলেকট্রনিক, গৃহস্থালি, পোশাক ও খাবারের ব্র্যান্ডের নতুন অনেক বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয়েছে। পল্লবী স্টেশন পার হতেই দেখা গেল বদলে যাওয়া এক পরিবেশ। মিরপুর-১২ এলাকায় রাস্তার পাশে একসময় পাঁচ-ছয়টি পোশাক কারখানা ছিল। এখন সেখানে একটি মাত্র পোশাক কারখানা রয়েছে। বাকিগুলো বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ বা কমিউনিটি সেন্টারে পরিণত হয়েছে। এখানে রয়েছে আড়ং, ইনফিনিটি, লারিভ, টুয়েলভ, আর্টিসান, মিনিসো, বাটা, অ্যাপেক্স, লোটো, রাইস, স্বপ্ন, প্রিন্স বাজারসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্র।
বিক্রেতারা জানান, এই এলাকার গ্রাহক মূলত মিরপুর ডিওএইচএসের বাসিন্দারা। তবে মেট্রোরেলে চড়ে উত্তরা ও মিরপুরের অন্যান্য এলাকা থেকেও অনেকে এখানে কেনাকাটা করতে আসছেন। পোশাকের ব্র্যান্ড লা রিভের মিরপুর-১২ শাখার ব্যবস্থাপক সৈকত আহমেদ বলেন, ‘মেট্রোরেল চালুর পর আগারগাঁও থেকে উত্তরার মধ্যবর্তী এলাকার গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে।’
চাহিদা বাড়ছে আবাসন খাতে
রাজধানীর মিরপুর এলাকা একসময় যানজট ও ধুলাবালুময় এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। গত দেড় দশকে সেই মিরপুরের বিভিন্ন সড়ক প্রশস্ত হয়েছে, গড়ে উঠেছে ডিওএইচএসের মতো আধুনিক আবাসন। সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো মেট্রোরেল প্রকল্প, যেটি উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যোগাযোগ সহজ করে তুলেছে। সব মিলিয়ে মিরপুর বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। এ কারণে আবাসন খাতের বড় কোম্পানিগুলোও মিরপুরকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
আবাসন খাতের কোম্পানি নাভানা রিয়েল এস্টেটের বিক্রয় বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সহজ যোগাযোগের কারণে মিরপুর এখন সবার কাছেই আকর্ষণীয় জায়গায় পরিণত হয়েছে। তাতে ফ্ল্যাটের চাহিদা বেড়েছে, সেই সঙ্গে দামও বেড়েছে। আগে এই এলাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ছিল ৩-৪ হাজার টাকা। এখন প্রতি বর্গফুটের দাম ৮-১০ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।
অনলাইনে পছন্দের বাসা বা ফ্ল্যাট অনুসন্ধান ও দরদাম সম্পর্কে জানা যায় অনলাইন মার্কেটপ্লেস বিপ্রপার্টিতে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, রাজধানীর উত্তরা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের পাশাপাশি মিরপুর এলাকাও এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মিরপুরে ভাড়া বাসা ও ফ্ল্যাট কেনার চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে; ভাড়ার পরিমাণও বেড়েছে। ২০২৩ সালে প্ল্যাটফর্মটিতে শুধু মিরপুর এলাকায় ২৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ মানুষ প্রপার্টি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অন্যান্য এলাকার মধ্যে উত্তরায় এ হার ছিল ১২ শতাংশ ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
বিপ্রপার্টির সেলস ও বিজনেস অপারেশনের পরিচালক মনির আহমেদ খান জানান, ২০২৩ সালে নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে দেশের আবাসন খাত অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এ খাতে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ছিল। বিশেষ করে মেট্রোরেল চালুর কারণে মিরপুর এলাকায় আবাসন খাতে চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
মেট্রোরেল চালু হওয়ায় মিরপুর এলাকার চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও দিয়াবাড়ীর মতো দর্শনীয় স্থানে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। বিশেষ করে এসব স্থানে উত্তরা ও ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের মানুষের যাতায়াত অনেক সহজ হয়েছে।
উত্তরা ও মিরপুরের যাত্রীরা বলছেন, আগে স্থানভেদে যানজট ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে তাঁদের এক থেকে আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগত। এখন তাঁরা সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টার মধ্যে গন্তব্যে যেতে পারছেন।
চ্যালেঞ্জও রয়েছে
অবশ্য মিরপুর-১২ থেকে উত্তরা উত্তর স্টেশন পর্যন্ত এলাকায় গত এক বছরে বড় কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি। এই এলাকায় আগে থেকেই বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর বাইরে নতুন আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে গত এক-দুই বছরে এই এলাকার সম্প্রসারণে তেমন গতি আসেনি।
অর্থনৈতিক কারণে ব্যবসায় ধীর গতির কথা জানিয়েছেন অন্য খাতের ব্যবসায়ীরাও। মিরপুরের কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া এলাকা আসবাব ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরুর পরও এ এলাকায় কমবেশি গ্রাহক ছিল। তবে করোনার সময় গ্রাহকসংখ্যা একেবারেই কমে যায়। এখন মেট্রোরেল চালুর পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। তবে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে যে হারে বিক্রি বাড়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না।
আসবাব খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম এইচ রহমান বলেন, সড়কব্যবস্থা ভালো হওয়ায় মিরপুরের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে গ্রাহকের যাতায়াত আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই কমবেশি চাপের মধ্যে রয়েছে। সংকট কমতে থাকলে ব্যবসায়ও গতি বাড়বে।