রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর একটি রূপালী ব্যাংক। ব্যাংকটির ঋণ ও আমানতের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব।
প্রায় দেড় বছর হয়েছে আপনি এই ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রাষ্ট্রমালিকানাধীন অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় রূপালী ব্যাংক কেমন করছে?
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: রাষ্ট্রমালিকানাধীন বড় চারটি ব্যাংকের মধ্যে শাখার সংখ্যা বিবেচনায় আমরা চতুর্থ। এ ছাড়া আমানত ও ঋণ অন্য তিন ব্যাংকের বেশি। গত দেড় বছর আগে যখন দায়িত্ব নিই, তখন এই ব্যাংকের বেশির ভাগ সূচকই ছিল নিম্নমুখী। ব্যাংকের মুনাফা মাত্র ৫৩ কোটি টাকা ছিল। তাতে প্রতিদিন বড় অঙ্কের টাকা ধার করে ব্যাংকটি পরিচালিত হতো। এ জন্য যোগ দেওয়ার পর সবার মতামত নিয়ে ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। সবাই যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেন, সে জন্য নিজে সব বিভাগের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। এতে ২১ দিনের মধ্যে ব্যাংকটির তারল্য উদ্বৃত্ত হয়ে যায়। নগদ ঋণ আদায় হয় ৫০১ কোটি টাকা। গত বছরে যা বেড়ে ৫২৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ আদায় দেশের যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি। এখন ঋণ দেওয়ার মতো আমাদের যথেষ্ট তহবিল আছে। কৃষি ও এসএমই খাতে ঋণ দিচ্ছি। সবার প্রচেষ্টায় রূপালী ব্যাংক এখন ভালো করছে।
১০০ দিনের বিশেষ কর্মসূচি তাহলে রূপালী ব্যাংকের চেহারা বদলে দিয়েছে?
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: নতুন পথে যাত্রা শুরু হয়েছে ১০০ দিনের কর্মসূচির মাধ্যমে। এখনো যা চলমান। ১০০ দিনের কর্মসূচিতে আমরা নতুন গ্রাহকদের ব্যাপক সাড়া পাই। নতুন করে প্রায় আট লাখ গ্রাহক ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন। ২০২৩ সালে আমানত বেড়েছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। আর ঋণ বেড়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে রূপালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ছিল ২১, গত বছর শেষে তা কমে হয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশ।
রূপালী ব্যাংক বিক্রির জন্য একসময় আলোচনা উঠেছিল। সরকার নিজের মালিকানায় ব্যাংকটি রেখে দিল, এর সুফল কি দেশের জনগণ পাচ্ছে?
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: একটি চক্র ব্যাংকটি বিক্রির জন্য চেষ্টা করেছিল। তবে তারা সফল হয়নি। এই বিক্রির উদ্যোগ ব্যাংকটিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তবে সরকার বিক্রি না করায় ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেবার মান, ব্যাংকের অবকাঠামো ও পরিবেশ আমরা এমন উন্নত করেছি। গ্রাহকেরা এখন নিজ উদ্যোগেই ব্যাংকে আসছেন। গ্রাহকদের পেছনে ছুটতে হচ্ছে না। ব্যাংকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বেসরকারি ব্যাংক। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের মতো উন্নত সেবা মিলছে রূপালী ব্যাংকে। ফলে ভালো গ্রাহকেরাও এখন ব্যাংকে আসছেন। ব্যাংক বিক্রি না হওয়ায় সুফল পাচ্ছে দেশের জনগণ। কম খরচে ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। ঘরে বসে অ্যাপের মাধ্যমে সেবা নিতে পারছেন গ্রাহকেরা।
রূপালী ব্যাংকের খারাপ দিক সামনে এলেই আসে স্থানীয় শাখার কথা। ব্যাংকটির ৬০-৭০ শতাংশ ঋণ এই শাখার মাধ্যমে গেছে। বড় কয়েকজন গ্রাহকের কারণে খেলাপিও বেশি।
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ, ব্যাংকের বেশির ভাগ ঋণ গেছে স্থানীয় শাখার মাধ্যমে। যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ খারাপ হয়ে পড়েছিল, তারা ব্যবসা চলমান রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মাদার ও বেনিটেক্স গ্রুপ তাদের ঋণ নিয়মিত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মাদারীপুর গ্রুপের ঋণ নিয়মিত নেই। এটা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এই কারখানা সরকারের কাছে ফেরত দিয়ে দিলে ঋণটিও ঠিক হয়ে আসবে।
ব্যাংক খাতে ডলারের পাশাপাশি তারল্যসংকট চলছে। এটা কীভাবে দূর হবে?
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: দেশের অনেক ব্যাংকে টাকার ঘাটতি থাকলেও আমাদের ব্যাংকে সেই সমস্যা নেই। ৫৫ হাজার কোটি টাকার আমানত আমরা দেড় বছরে ৬৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করেছি। তার মানে দেড় বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। আগে একসময় অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে ব্যাংক চালাতে হতো। এখন অন্য ব্যাংকগুলোকে আমরা টাকা ধার দিচ্ছি। এটা বড় একটা অর্জন। এর পেছনে রয়েছে গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধি ও গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জন করা। গ্রাহকেরা বিশ্বাস করেন, আমাদের ব্যাংকে টাকা রেখেছেন বলেই আমরা অন্যদের ধার দিতে পারছি। গ্রাহকের বিশ্বাসের টাকা আমরা এমন কারও কাছে তুলে দিতে চাই না, যা ফেরত আনতে কষ্ট করতে হবে।
প্রায় দুই বছর ধরে ডলার–সংকট চলছে। রূপালী ব্যাংক কীভাবে এ সংকট মোকাবিলা করছে।
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: যারা নিয়মের মধ্যে আছে, তাদের ডলার–সংকট কিছুটা হলেও কম। আমরা ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে কোনো ডলার কেনাবেচা করিনি। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের প্রশংসা করছে। ঘোষিত দামে কেনাবেচা করায় আমাদের ব্যাংকে ডলারের সরবরাহ কম। এটা আমরা নানাভাবে মিটিয়ে আসছি। সম্প্রতি বিমানবন্দর বুথে নানা ব্যাংকের ডলার কেনার ক্ষেত্রে অনিয়ম ধরা পড়েছে। তবে আমাদের কোনো অনিয়ম ধরতে পারেনি কেউ।
নতুন করে কী সেবা চালু করতে যাচ্ছে রূপালী ব্যাংক?
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: আমরা শিওর ক্যাশের সঙ্গে মোবাইলে আর্থিক সেবা চালু করেছিলাম। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে নিজেরাই সেবাটি চালু করতে যাচ্ছি। এ জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। যারা আগামী এপ্রিলের মধ্যে রূপালী ব্যাংকের জন্য এমএফএস সেবাটি চালুর উপযোগী করে বুঝিয়ে দেবে। এরপর আমরা এই সেবা চালু করলে তা হবে দেশের সরকারি ব্যাংকের প্রথম এমএফএস সেবা।
নতুন বছরে রূপালী ব্যাংকের লক্ষ্যগুলো কী?
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: নতুন বছরে আমরা রূপালী ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর মাধ্যমে দেশের এক লাখ মুয়াজ্জিনকে বেতন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া প্রতিটি সূচক ধরে আলাদা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব ও আমানত গত বছরের তুলনায় দেড় গুণ বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে শাখাগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে মূল্যায়ন করা হবে—এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: নতুন পথে যাত্রা শুরু হয়েছে ১০০ দিনের কর্মসূচির মাধ্যমে। এখনো যা চলমান। ১০০ দিনের কর্মসূচিতে আমরা নতুন গ্রাহকদের ব্যাপক সাড়া পাই। নতুন করে প্রায় আট লাখ গ্রাহক ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন। ২০২৩ সালে আমানত বেড়েছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। আর ঋণ বেড়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে রূপালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ছিল ২১, গত বছর শেষে তা কমে হয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশ।