কল্পনা করা যাক, বাংলাদেশের একটি কর্মব্যস্ত পোশাক কারখানা। শ্রমিক ভাইবোনেরা নিবিষ্ট মনে কাজ করছেন। অনেকটা ছন্দের তালে তালে কানে আসছে সেলাই মেশিনের শব্দ। এই সুন্দর দৃশ্যপট মুহূর্তের মধ্যেই বদলে যায় আকস্মিক বিদ্যুৎবিভ্রাটে। বিদ্যুৎবিভ্রাট যে কালেভদ্রে ঘটে, তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের নিত্যদিনের সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিদ্যুৎবিভ্রাট সমস্যা, যা কারখানার উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য জাহাজীকরণ ঝুঁকি তৈরি করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুনাফা করার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তৈরি পোশাকের মতো একটি বৈশ্বিক শিল্প, যার প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রেখে স্বল্প মার্জিন নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। এখানে বিদ্যুৎবিভ্রাট নিছক উৎপাদন বিঘ্নকারী নয়, বরং তার চেয়েও আরও বেশি কিছু। এটি জীবিকাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়, প্রবৃদ্ধি হ্রাস করে। পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
অনেকটা সাধারণ সর্দি-জ্বরের মতো মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানিসংকট (গ্যাস-বিদ্যুৎ) শিল্পের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিতে বাধ্য। এতে সামগ্রিকভাবে খাতের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাবেই। প্রতিবার বিদ্যুৎবিভ্রাট মানেই ডিজেলচালিত জেনারেটরের পেছনে অতিরিক্ত ব্যয় করা, সম্পদের অপচয় করা, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যের মতো উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জন থেকে পিছিয়ে পড়া।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গ্যাসের অভ্যন্তরীণ মজুত হ্রাস পাওয়ায় আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনায় বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বেড়েছে। তাতে চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি কিনতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। আজকের ডলার–সংকটের পেছনে এটাও একটি কারণ। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও প্রয়োজনীয় এলএনজি কিনতে পারছে না সরকার।
লোডশেডিং: শিল্পের নীরব ঘাতক
শুধু প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি ঘাটতি নয়, বিদ্যুৎ খাতে নাজুক অবকাঠামো, বিশেষ করে সঞ্চালন লাইন, সাবস্টেশন ও পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালী না হওয়ায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন মৌসুমে ঘন ঘন লোডশেডিং হয়।
ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাটে উৎপাদনে বিলম্ব, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য জাহাজীকরণে ব্যর্থ হওয়া ও অতিরিক্ত ওভারটাইম বাবদ কারখানাগুলোর পরিচালন ব্যয় বাড়ায়। উৎপাদন চালিয়ে নিতে কারখানাগুলো ডিজেলচালিত জেনারেটরের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছে। এতে উচ্চমূল্যের ডিজেল কিনতে অতিরিক্ত খরচের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অন্যদিকে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। পরিবেশ দূষণকারী জ্বালানি উৎসের ওপর এই নির্ভরশীলতা পরিবেশবান্ধব সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশের নতুন ব্র্যান্ডিংকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অনেক কারখানাই ‘ক্যাপাসিটি ট্র্যাপ’–এ আটকা পড়েছে। এর অর্থ হলো, কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ছে, যদিও জ্বালানি সক্ষমতা নেই। উদ্যোক্তারা বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে কারখানার আকার বড় করেছেন। বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি এনে কারখানার আধুনিকায়নও করেছেন। অথচ জ্বালানি অবকাঠামো অনুন্নতই রয়ে গেছে। যদিও বিশ্বের ব্র্যান্ডগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর ওপর বেশ জোর দিচ্ছে। ফলে আমাদের উদ্যোক্তারা নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি: স্বপ্ন নাকি বাস্তব
বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষ করে সৌর প্যানেল স্থাপন বেশ বেড়েছে। এই প্রচেষ্টা পোশাক খাতের জ্বালানি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সৌর প্যানেলগুলো শুধু চাহিদার একটি ভগ্নাংশ পূরণ করতে পারে। বড় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর লজিস্টিক সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রকমূলক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। যদিও সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য সাময়িক সমাধানের চেয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রয়োজন। এই যাত্রা শুরু করা যেতে পারে একটি জ্বালানি পথনকশা দিয়ে, যেখানে জ্বালানির জন্য উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন শিল্পাঞ্চলগুলোয় সৌর ও বায়ুর মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
একই সঙ্গে শিল্পকারখানাগুলোকে জ্বালানি দক্ষতা বাড়াতে উৎসাহ দিতে পারে সরকার। যেভাবে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে-
১) সরকার কারখানাগুলোকে স্বল্প সুদে ঋণ, কর অব্যাহতি সুবিধা ও জ্বালানি দক্ষ প্রযুক্তির জন্য ভর্তুকি দিয়ে সহায়তা করতে পারে। লাইটিং সিস্টেম, এইচভিএসি ও যন্ত্রপাতি আপগ্রেড করা হলে বিদ্যুতের ব্যয় কমবে।
২) সহজ চুক্তির মাধ্যমে কারখানাগুলোকে সরাসরি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ক্রয়ের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টিও চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। এটি সম্ভব হলে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থিতিশীল থাকবে। জাতীয় গ্রিডের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
৩) পোশাক খাতে বড় আকারের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সমাধানের জন্য অর্থায়নে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো সহযোগিতামূলক প্রকল্প নিতে পারে। এতে জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে জ্বালানিসংকটের শিগগিরই সমাধান না হলে নিকট ভবিষ্যতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। কারণ, নিরবচ্ছিন্ন, সাশ্রয়ী ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ ছাড়া শিল্পের সম্প্রসারণ ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশ যদি পোশাকশিল্প খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চায়, তবে দেশটিকে সাহসী, কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জ্বালানিসংকট মোকাবিলা করতে হবে। জ্বালানিসংকট সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে আরেক ধাপ শক্তিশালী করতে পারে।
লেখক: মো. মহিউদ্দিন রুবেল, সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ