বিশ্ব এমএসএমই দিবস সামনে রেখে এ খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মাসুদুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম।
দেশের এসএমই খাতের জন্য বর্তমানে প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
মো. মাসুদুর রহমান: দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় বর্তমানে ব্যবসায় টিকে থাকা এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বেশির ভাগ এসএমই প্রতিষ্ঠান ছোট পুঁজির উদ্যোক্তা। তারা যে পণ্য উৎপাদন করে, সেগুলো বিক্রি করে পুনরায় উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে পণ্য ও সেবার মূল্য আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে কয়েক গুণ বেড়েছে। এতে উৎপাদন ব্যয়ও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। সে তুলনায় উদ্যোক্তারা পণ্য-সেবার দাম বাড়াতে পারেনি। ফলে তারা উৎপাদন কমিয়ে, কম মুনাফা করে কিংবা কেউ কেউ লোকসানে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে।
বৈশ্বিক কারণের বাইরে দেশের অভ্যন্তরে কোনো সমস্যা দেখছেন কি?
মো. মাসুদুর রহমান: অর্থায়ন এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য এখনো বড় একটি সমস্যা। তাদের জন্য স্বল্প সুদে সহজে ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়াটি এখনো সহজ হয়নি। অন্যদিকে উদ্যোক্তা ও কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে পণ্যের উৎকর্ষ বাড়ানো যাচ্ছে না। এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে না পারলে এ খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
সম্প্রতি ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে এসএমই উদ্যোক্তাদের ওপর কেমন প্রভাব পড়বে?
মো. মাসুদুর রহমান: আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা যে ঋণ নেন, তার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে থাকেন। বাকি অর্থ তাঁরা অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে নেন। যার সুদের হার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধি পেলেও ছোট উদ্যোক্তাদের তেমন সমস্যা হবে না; বরং ঋণের সহজলভ্যতাই উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।
প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এসএমই খাতের অগ্রগতি কেমন?
মো. মাসুদুর রহমান: মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এসএমই খাতের অবদান ৩০ শতাংশের মতো। যদিও এটি প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। তবে আমরা খুব সীমিত হলেও একটু একটু করে ধারাবাহিকভাবে সামনের দিকে এগোচ্ছি। করোনা ও বর্তমানে যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকট তৈরি না হলে এসএমই খাতের অগ্রগতি আরেকটু বাড়ত।
এসএমই খাতের উন্নয়নে এসএমই ফাউন্ডেশন কতটা অবদান রাখছে?
মো. মাসুদুর রহমান: এসএমই ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা। গত ২০০৮-০৯ সাল থেকে সারা দেশে আমরা কয়েক লাখ উদ্যোক্তা তৈরি করতে পেরেছি। ব্যক্তি উদ্যোক্তার পাশাপাশি ক্লাস্টারভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্পায়নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এসএমই ফাউন্ডেশন। গবেষণা করা, উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া, আধুনিক উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ইত্যাদি কাজ আমরা নিয়মিতভাবে করে যাচ্ছি। উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করাও এসএমই ফাউন্ডেশনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। এসএমই ফাউন্ডেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা উদ্যোক্তাদের ঋণ দিই। এই ঋণ ফেরতের হার প্রায় শতভাগ।
একটি এসএমই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি জানানো হচ্ছে। আপনি কি এ দাবিকে সমর্থন করেন?
মো. মাসুদুর রহমান: আমাদের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের অনেকের কাছ থেকে এই দাবি আসছে। তবে আমি মনে করি, বিদ্যমান ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে এসএমইবান্ধব করা গেলে নতুন ব্যাংকের বদলে সেটি আরও বেশি কার্যকর হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের মান নিয়ে অনেক সময় অভিযোগ পাওয়া যায়। তারা কতটা মান নিশ্চিত করতে পারছে বলে মনে করেন?
মো. মাসুদুর রহমান: গত ১০-১৫ বছরে আমাদের উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্যের গুণগত মানে অনেক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় পণ্যের মান এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারিনি।
উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে আর কী ধরনের সমস্যায় বেশি পড়তে হয়?
মো. মাসুদুর রহমান: এসএমই প্রতিষ্ঠানের একটা বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতের। তারা আনুষ্ঠানিক খাতের প্রতিষ্ঠানের মতো নথিপত্র সংরক্ষণ করে না। এ জন্য অনেক সময় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে উদ্যোক্তারা দিন দিন সচেতন হচ্ছেন। আরেকটি দিক হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ে যে ঋণ বিতরণ হয়, তার মাত্র ৫-৬ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তারা পেয়ে থাকেন। সুতরাং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হলে তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।