ব্রিকসের জোহানেসবার্গ শীর্ষ সম্মেলন থেকে তিন মহাদেশের ছয়টি দেশকে বিকাশমান অর্থনীতির এই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দেশগুলো হলো সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইথিওপিয়া ও আর্জেন্টিনা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনের আগে ২২টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে আবেদন জানিয়েছিল। যোগদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল আরও ২০টি দেশ। আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানানো দেশের মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। তবে বাংলাদেশ আপাতত এই জোটে সদস্য হিসেবে যোগ দিতে পারছে না।
নতুন ছয়টি সদস্যদেশ আগামী বছরের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে যোগ দেবে বলে ঠিক হয়েছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার এই জোট মনে করেছে, তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য এই মুহূর্তে ওই ছয় দেশের যোগ্যতা রয়েছে।
ব্রিকসের সম্প্রসারণ ছিল জোহানেসবার্গ সম্মেলনে অন্যতম আলোচ্য বিষয়। কিন্তু নতুন সদস্য বাছাইয়ের কাজটি খুব সহজ হয়নি। এ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হয়, বেশ সময় নিয়ে ব্রিকসের সদস্যদেশের নেতারা শেষে একমত হন। জোটে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, কিন্তু আমন্ত্রণ পায়নি এমন দেশের মধ্যে আরও রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া ও আলজেরিয়া।
এই দেশগুলোকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণ সম্পর্কে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে নতুন সদস্যদের নাম ঘোষণা করে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, এমন একটি বিশ্ব যা হবে ন্যায্য, এমন একটি বিশ্ব যা হবে ন্যায়পরায়ণ, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধিশালী, তেমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্রিকস একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।
ব্রিকসভুক্ত পাঁচ দেশের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ। বৈশ্বিক জিডিপির ২৫ শতাংশের বেশি ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর। সুতরাং অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের বিবেচনায় ব্রিকসকে অতি সম্ভাবনাময় একটি জোট মনে করে হয়। তবে জোট সম্প্রসারণের সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক বিবেচনা কতটা ভূমিকা রেখেছে, সেটি পরিষ্কার নয়।
ব্রিকস সম্প্রসারণের আলোচনা বুধবার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গড়ায়; কারণ, নেতারা নতুন সদস্যদের ব্যাপারে একমত হতে পারছিলেন না। প্রকাশ্যে সব নেতাই বলছিলেন যে তাঁরা ব্রিকসের সম্প্রসারণ চান, তবে কটি দেশকে সদস্য হিসেবে নেওয়া হবে এবং কত দ্রুত তাদের সদস্যপদ দেওয়া হবে, এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভিন্নমত ছিল।
ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অর্থনীতির মধ্যে যেমন বিশাল পার্থক্য রয়েছে, তেমনই এসব দেশের সরকারের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পররাষ্ট্রনীতি। সে কারণে তাদের পক্ষে একমত হওয়া ছিল বেশ কঠিন। বিষয়টি ফয়সালা হতে আরও সময় নেয় যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে দুটি যোগ্যতা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদি যে দুটি শর্ত প্রস্তাব করেন তা হলো, সদস্য হতে আগ্রহী দেশ কোনো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু হবে না এবং তাদের মাথাপিছু জিডিপির একটি ন্যূনতম মানদণ্ড থাকতে হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কতটা বিবেচনা করা হয়েছে, তা নিয়ে ব্রিকস সম্মেলনের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। বুধবারের প্লেনারি অধিবেশনের পরেই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকলেও রয়টার্সকে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের পর এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়।
যে ছয়টি দেশকে ব্রিকসে নতুন সদস্য হিসেবে নেওয়া হয়েছে, তাদের মাথাপিছু জিডিপির বিপুল পার্থক্য রয়েছে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ মাথাপিছু জিডিপির দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের তথ্যানুযায়ী ৫৩ হাজার ৭৫৮ ডলার), আর সবচেয়ে কম ইথিওপিয়ার (বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ২৭ ডলার)। ইথিওপিয়ার তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি অনেক বেশি, ২ হাজার ৬৮৮ ডলার (বিশ্বব্যাংক ২০২২)। ইন্দোনেশিয়ার আরও বেশি, ৪ হাজার ৭৮৮ ডলার। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়েও কম, ২ হাজার ৩৮৮ ডলার।
অন্যদিকে যে দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার নিশানায় রয়েছে বলে মনে করা হয়, তারা হলো ইরান ও ভেনেজুয়েলা। এদের মধ্যে ইরানকে ব্রিকসের নতুন সদস্য হতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ব্রিকসের কোনো কোনো নেতা এর আগে খোলাখুলিভাবে নতুন একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা এবং মার্কিন ডলারবিহীন একটি আর্থিক ও বাণিজ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ব্রিকস মুদ্রা নামে একটি মুদ্রা চালু করারও প্রস্তাব দিয়েছেন। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের চেষ্টা রয়েছে ব্রিকসকে পশ্চিমা জোটের বিপরীতে একটি আলাদা শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে।
জোটে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, ‘বিশ্ব এখন একটি অশান্ত ও রূপান্তরের নতুন সময়ের মধ্যে রয়েছে। ঐক্যের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী করতে হবে, প্রতিষ্ঠাকালীন এই লক্ষ্যের কথাটি আমাদের ব্রিকস দেশগুলোর সব সময় মনে রাখতে হবে।’
কেবল ছয়টি দেশকে কেন সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে, তা ব্রিকসের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়নি। তবে অর্থনৈতিক শক্তি বা বাণিজ্য সম্ভাবনার চেয়ে ভূরাজনৈতিক বিবেচনা নতুন সদস্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব দেশের বেশির ভাগের সঙ্গে চীন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাশিয়া সম্প্রতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। নতুন সদস্য ছয় দেশের মধ্যে সৌদি আরব, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রয়েছে বিপুল তেলসম্পদ।
গত জুন মাসে ব্রিকসে যোগ দিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। সে সময় জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠকের পর মূলত বিষয়টি সামনে আসে। ওই বৈঠকের পর অর্থাৎ ১৪ জুনের পর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের সদস্যপদের জন্য আবেদন করে।
তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাধারণত এ ধরনের কোনো ফোরাম বা জোটে যোগ দিতে শুধু আবেদন করে বসে থাকলেই চলে না। কারণ, এ ক্ষেত্রে সদস্যদেশগুলোকে নতুন কোনো দেশকে যুক্ত করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হয়। ফলে ওই সব দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানোর পাশাপাশি এই দেশগুলোতে বিশেষ দূত পাঠানোর মতো প্রয়াস চালাতে হয়। জুনে আবেদন করা ছাড়া এসবের কিছুই বাংলাদেশ করেনি।
অন্য একটি সূত্রের দাবি, ব্রিকসের নতুন সদস্য পদের মানদণ্ড কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি ছিল। এটা জানার পর বাংলাদেশও ব্রিকসের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
তবে বাংলাদেশের জন্য ব্রিকসের সদস্য হওয়ার দরজা একবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, ‘আমরা প্রথম দফার সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছি এবং ভবিষ্যতে এটি আরও হবে।’