পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দীর্ঘ আন্দোলনের পর শেষমেশ মজুরি যা নির্ধারণ করা হলো, তাতে একটি প্রশ্নই মনে আসছে। সেটি হলো, মজুরি কি বাড়ল নাকি কেবল মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার বিনিময় হারের সঙ্গে সমন্বিত হলো? অর্থাৎ এ মজুরি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ল নাকি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে ক্রয়ক্ষমতা যে কমে গিয়েছিল, সেই ক্ষতি কিছুটা পূরণ হলো?
২০১৮ সালে তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারিত হয়েছিল। অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম দেখিয়েছেন, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল—এই পাঁচ বছরে দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির (মূল্যস্ফীতি) যোগমূলক পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ। শুধু দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির বিবেচনায় ২০২৩ সালে মজুরির সমমান হওয়ার কথা ১১ হাজার ৭২৯ টাকা।
২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল—এই পাঁচ বছরে দ্রব্যের গড় বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল আনুমানিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ১২ হাজার ৫০০ টাকা যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কেবল মূল্যস্ফীতি সমন্বয়, শ্রমিকের জীবনযাপনের অন্যান্য চাহিদার কথা বিবেচনা করা হয়নি; বরং শ্রমিকদের যে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, তা-ও আমলে নেওয়া হয়নি।
বিষয়টি হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সরাসরি সম্পর্ক আছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তার ব্যয় করার সক্ষমতা বাড়বে, তখন জিডিপির পালে হাওয়া লাগবে। মালিকদেরও বোঝা উচিত, শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তাঁদের ব্যয় বাড়বে।
এতে অর্থনীতিতে যে গতি আসবে, তার সুফল মালিকেরাও পাবেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ অনেক প্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন। তাই এখন মজুরি বাড়ানো হলে মানুষের যে ব্যয় বাড়বে, তাতে মালিকদের অন্যান্য পণ্যের বিক্রি বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকলেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। ইউরোপ মহাদেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে অর্থনীতির শ্লথগতি মোকাবিলায় ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করেছে।
বাস্তবতা হলো, তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি যে হারে বৃদ্ধি করা হলো, তা কার্যত মজুরি বৃদ্ধি নয়, বরং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয়। ফলে এ মজুরিতে শ্রমিকদের জীবনমানের বিশেষ উন্নতি হবে না।
নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে (যেমন এক বছরে) কোনো অঞ্চলের উৎপাদিত সব পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্যকে স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বলে। জিডিপি একটি অঞ্চলের অর্থনীতির আকার নির্দেশ করে। বিবেচ্য অঞ্চলটি যদি একটি দেশ হয়, তবে একে মোট দেশজ উৎপাদন হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। অর্থাৎ জিডিপি = ভোগ + বিনিয়োগ + সরকারি ব্যয় + (রপ্তানি-আমদানি)। ভোগ এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তা বাড়াতে হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন হয় এবং সে বিষয়ে দেশে এখন একধরনের সচেতনতাও গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠন সেখানে সমর্থন দেয়। দেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশ যেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, সেখানে শ্রমিকদের আন্দোলন করার মতো বাস্তবতা নেই। তবে এসব খাতেও মজুরি সমন্বয় হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, গত অক্টোবর মাসে নিম্ন ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অথচ গত মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সেই হিসাবে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির তুলনায় ২ দশমিক ২৪ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। অর্থাৎ এমনিতেই যেখানে মজুরি কম, সেখানে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হলে বিষয়টি বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো হয়ে যায়।
বাস্তবতা হলো, দেশের বিপুলসংখ্যক অদক্ষ ও নিম্ন দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমজীবী মানুষ এখন আর পরিবার নিয়ে বড় শহরে থাকার সাহস করছেন না। পরিবারকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। এসব পরিবারের শিশুদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে তাঁদের কর্মদক্ষতা কমে যাবে। মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
২০২৬ সালের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশকে যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে, তার জন্য শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সে জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের পাশাপাশি শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি ঘটানোর বিকল্প নেই। এই মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের পক্ষে কোনোভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা সম্ভব, জীবনের গুণগত মান বৃদ্ধি নয়। অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি এখন তৈরি পোশাক খাতের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত বলছে, শ্রমিকদের এমন মজুরি দেওয়া উচিত, যাতে জীবনযাত্রার নির্বাহের পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু ব্যয় করার সামর্থ্য তাঁদের থাকে।
শুধু পোশাকশ্রমিক নয়, দেশের বেসরকারি খাতের বিপুলসংখ্যক নিম্ন-মধ্যম সারির কর্মীরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছেন। তাঁদের মজুরি/বেতন বাড়ানো দরকার। কিন্তু পোশাকশ্রমিকেরা আন্দোলন করতে পারলেও তাঁরা পারেন না বা সেই সামাজিক সমর্থন ও পুঁজি তাঁদের নেই।
প্রায় দুই বছর ধরে দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষেরা হিমশিম খাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমেই যেটা করে, সেটা হলো খাদ্য ব্যয় হ্রাস করা; পরিণামে পরিবারের পুষ্টিমানে প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা এ পরিস্থিতির শিকার হন। শিশুরা অপুষ্টির শিকার হলে পরবর্তীকালে তাদের কর্মদক্ষতায় প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে পরিণত বয়সে তাদের যে কর্মদক্ষতা থাকার কথা, সেটা থাকে না।
এ বাস্তবতা কোনো দেশের জন্যই ভালো নয়। বিশেষ করে আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে আসছি। স্বল্পোন্নত দেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা হারানোর পর আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে, তখন শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কিন্তু এখনকার শিশু-কিশোরেরা অপুষ্টির শিকার হলে তাদের পক্ষে পরিণত জীবনে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।
সেই সঙ্গে বৈষম্য সারা পৃথিবীতে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ বছর ধরে মধ্যম সারির কর্মীদের প্রকৃত আয় (মূল্যস্ফীতি সমন্বয়সহ) স্থবির হয়ে আছে। মাঝারি আয় ও শীর্ষ আয়ের ব্যবধানের দুই ধরনের ব্যাখ্যা আছে। দুটো ব্যাখ্যার মধ্যে কোনটা সঠিক, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রথম ব্যাখ্যা হচ্ছে, বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মতো নৈর্ব্যক্তিক ও অপ্রতিরোধ্য প্রক্রিয়াগুলোর ফলে নিম্ন দক্ষতার শ্রমিকের মজুরি কমে যায় আর উচ্চশিক্ষিতদের আয় বাড়ে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো, মাঝারি আয়ের স্থবিরতা মূলত ধনীদের আয় বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ফল—এই মতের লোকেরা মনে করেন, ধনীরা অন্যদের শোষণ করে আরও ধনী হচ্ছেন।
পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের সময় একজন পোশাকমালিক সখেদে বলেছিলেন, সরকারি দপ্তরে ও রাস্তায় ঘুষ বন্ধ হোক, তাহলে শ্রমিকদের বেশি মজুরি দিতে আমাদের সমস্যা হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে কর্মীদের মজুরি বা বেতন বাবদ একটি প্রতিষ্ঠানের মোট ব্যয়ের খুব বেশি ব্যয় হয় না।
বিশ্বব্যাংকের একটি লেখায় (ব্লগে) অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন লক্ষ করেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তৈরি পোশাকের মোট উৎপাদন খরচে মজুরি বাবদ খরচ মাত্র ১ থেকে ৩ শতাংশ। প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো রাজস্ব আয়ের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কর্মীদের বেতনভাতা বাবদ ব্যয় করে থাকে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা ১০ শতাংশের মধ্যে বলেই জানা যায়। কিন্তু দেশে ব্যবসার খরচ অনেক বেশি হয়ে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তাদের জন্য সমস্যাজনক। তবে মালিকপক্ষের মানসিকতাও অনেক ক্ষেত্রে বড় সমস্যা তৈরি করে, শ্রমিক/কর্মচারীদের মজুরি বা বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই উৎসাহী নন।
বাংলাদেশের সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এ বলা হয়েছে, যদি ব্যয় পদ্ধতি দ্বারা জিডিপি পরিমাপ করা হয়, তাহলে ভোগ ব্যয় বিশেষ করে বেসরকারি ব্যয়ই জিডিপির সিংহভাগ জোগান দেয়। বিবিএসের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী ২০২১-২২ সালে অর্থবছরে জিডিপিতে ভোগ ব্যয়ের অবদান ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের অবদান ৬৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং সরকারি খাতের অবদান ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ।
ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোগ ব্যয় কমলে আখেরে যে অর্থনীতিরই ক্ষতি, তা সবারই বোঝা দরকার।