দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সাহসী উদ্যোক্তা ছিলেন ফজলুর রহমান

৭৬ বছর বয়সে মারা গেছেন সিটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান। দেশের যেসব উদ্যোক্তা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা ও উদ্যোগে শূন্য থেকে বড় শিল্পোদ্যোক্তা হয়েছেন, তিনি তাঁদের একজন। মাত্র ৪২ টাকা পুঁজিতে একটি মুদিদোকান খুলে ব্যবসাজীবন শুরু করেন। তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪০টি। কাজ করেন ৩০ হাজার মানুষ।

মাহবুবুর রহমান

ফজলুর রহমান গুলশানে আমার প্রতিবেশী ছিলেন। গুলশানে বসবাস করলেও তাঁর ব্যবসা–বাণিজ্য ছিল পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। স্বাধীন বাংলাদেশে যে কয়জন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস ও স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন।

তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন, তা সাহস ও বিশ্বাস নিয়ে বাস্তবায়ন করতেন। স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসা–বাণিজ্য ছিল অবাঙালিদের দখলে। স্বাধীনতার পরপরই শিল্প ও ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। সেটিকে সাহসের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছিলেন এ দেশের কিছু উদ্যোক্তা। তাতে তাঁরা সফলও হয়েছেন।

ফজলুর রহমান বড় একজন শিল্পোদ্যোক্তা হলেও তাঁর আচার–ব্যবহারে কখনো তা প্রকাশ পেত না। খুব সহজ সরল ও সাধারণ জীবন যাপন করতেন। মানুষকে খুব সম্মান করতেন।

যেহেতু তিনি ভোগ্যপণ্যের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেহেতু তাঁদের বিরুদ্ধে অনেকে সিন্ডিকেট করার অভিযোগ করতেন। আমাদের কাছেও অনেকে তা বলতেন। ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগাযোগ থাকাটা দোষের কিছু নয়। সারা পৃথিবীতেই সমপর্যায়ের এক শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য শিল্পগোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে। তার মানে এই নয়, বাজারে একজোট হয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা। এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ফজলুর রহমান ও তাঁর প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল বলে আমার জানা নেই।

ফজলুর রহমানের সঙ্গে আমার জানাশোনা ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের মাধ্যমে। একসময় ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন নেদারল্যান্ডস থেকে ক্রুড অয়েল আমদানি করতেন। সেই ক্রুড অয়েল কিনে নিতেন ফজলুর রহমানসহ আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী। এ জন্য তিনি তেল পরিশোধন কারখানাও করেছিলেন।

তেল পরিশোধন ব্যবসা থেকে একে একে তিনি যুক্ত হন ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস বা এফএমসিজি ব্যবসার সঙ্গে। বর্তমানে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ে দেশি যেসব কোম্পানি রয়েছে, তার মধ্যে সিটি গ্রুপ শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের ব্যবসায়ে পণ্যের গুণগত মান উন্নত না হলে বাজারে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয় না।

ফজলুর রহমান একজন ভিশনারি বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোক্তা ছিলেন। এ কারণে তিনি নানা খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন। শিল্প বা ব্যবসার ক্ষেত্রে যাঁরাই সাহস নিয়ে কিছু করেন বা লেগে থাকেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা সফল হন। সহজ পথে ব্যবসায়ে বড় হওয়ার সুযোগ কম। যদিও বর্তমান সময়ে অনেকে ব্যাংকের টাকা মেরে রাতারাতি ব্যবসায়ী ও বড় লোক হয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা এ ধরনের কাজে যুক্ত, তাঁদেরকে আমি ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা মনে করি না। ফজলুর রহমান ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের কোনো অভিযোগ শুনিনি।

সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি সমাজের প্রতিও দায়িত্ব পালন করেছেন। পুরান ঢাকার মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য আজগর আলী হাসপাতাল করেছেন। আমার বিশ্বাস, তিনি ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে এ হাসপাতাল করেননি। মানুষের উপকারের জন্যই করেছেন। উদ্যোক্তাদের সামাজিক কিছু দায়বদ্ধতাও থাকে। ফজলুর রহমান সেই দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে ছিলেন না।

  • মাহবুবুর রহমান, সভাপতি, আইসিসি বাংলাদেশ