ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পকারখানায় শুরু হয়েছে শ্রমিক বিক্ষোভ। তাতে গাজীপুর, নরসিংদীসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকায় কারখানা বন্ধের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতের সমস্যায় জর্জরিত শিল্প খাত। তাতে নতুন বিনিয়োগ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থানেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা কথা জানিয়েছেন ওষুধশিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মোক্তাদির।
২০১৯ থেকে ২০২৪। এই পাঁচ বছরে দেশে ওষুধের বাজারে খুব বেশি প্রবৃদ্ধি হয়নি। ২০১৯ সালে ওষুধের দেশীয় বাজারের আকার ছিল ৩০০ কোটি বা ৩ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৪ সালে এসেও বাজারটি একই জায়গায় রয়ে গেছে। করোনার সময় ওষুধের ব্যবসা কিছুটা বাড়লেও গত কয়েক বছরের ব্যবসার খরচ এতটাই বেড়েছে যে অনেক কোম্পানি লোকসান গুনছে। এ কারণে ২০১৯ সালের আগে ওষুধ খাতে আমরা যে প্রবৃদ্ধি দেখে আসছিলাম, করোনার পর সেটি থমকে গেছে। পাঁচ বছর ধরে ওষুধের বাজারটি একই জায়গায় আছে।
একদিকে ব্যবসা বাড়েনি, অন্যদিকে ব্যবসার খরচ বেড়েছে হু হু করে। ৮৬ টাকার ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১২৪ টাকা। এতে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ছোট ও মাঝারি অনেক কোম্পানি লোকসানে চলে গেছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা দেখছি ডলারের বাজারটি অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। প্রবাসী আয় বাড়ছে। তাতে ডলারের দামও কিছুটা কমতে শুরু করেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক খবর। ডলারের বিনিময় মূল্য যদি ১১০ টাকায় নামিয়ে আনা যায়, তাহলে লোকসান গুনতে থাকে বেশির ভাগ ওষুধ কোম্পানি আবারও লাভের মুখ দেখবে। তাই নতুন সরকার ও গভর্নর এ দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের স্বার্থে ডলারের দাম কমিয়ে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা রাখছি।
ওষুধের উৎপাদনের ক্ষেত্রে বয়লারের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে শিল্পে গ্যাস–সংকট প্রকট। এ কারণে গ্যাসের বদলে ডিজেল দিয়ে আমাদের বয়লার চালাতে হচ্ছে। এর ফলে বয়লার ব্যবহারে জ্বালানি খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে উৎপাদন খরচের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে ওষুধের দামও বাড়ানো যাচ্ছে না। আবার ওষুধ জীবনরক্ষাকারী পণ্য হওয়ায় চাইলেই আমরা যখন তখন দাম বাড়াতে পারি না। এতে মুনাফায় বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে।
এদিকে ওষুধ খাতের আমাদের অনেক কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধ রপ্তানির জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ করে বসে আছে। বড় অনেক কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধ রপ্তানির জন্য দেশটির সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আবেদন করেছে। নিয়ম অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল এ দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিরীক্ষার পরই অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ও নিরাপত্তার কারণে এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধিদল এ দেশে নিরীক্ষার জন্য আসছে না। ফলে আমাদের আবেদনগুলোর বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিলে আমরা আশা করছি, যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধের বাজারে আমাদের বড় সম্ভাবনা দ্বার উন্মোচিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য বড় বাজার। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি সরবরাহে বাংলাদেশ ট্রেড এগ্রিমেন্ট অ্যাক্টের আওতায় বিশেষ সুবিধা পায়। এই আইনের আওতায় দেশটির সরকারি পর্যায়ে আমরা ওষুধ সরবরাহ করতে পারি। তাই সরকার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমাদের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা শুরুর বিষয়ে অবিলম্বে উদ্যোগ নিলে নতুন একটি সম্ভাবনা দ্বার খুলবে এ খাতে। তাই অন্তর্বতী সরকার এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেবে বলে আমরা আশা করি।
আমরা দেখেছি, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই অপ্রত্যাশিতভাবে ওষুধসহ শিল্প খাতে একধরনের শ্রম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। যদিও ওষুধ খাতের কোম্পানিগুলো নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্যা দাবিগুলো মেনে নেওয়ায় এ খাতের শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনার দ্রুত সমাধান করা গেছে। ওষুধ খাত এ দেশে কমপ্লায়েন্স মেনে চলা খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের বেশির ভাগ কোম্পানি শ্রমিকদের সরকার নির্ধারিত বেতন–ভাতার চেয়েও বেশি সুবিধা দেন। এ কারণে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা আমরা দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করতে পেরেছি। পাশাপাশি সরকারের দিক থেকেও প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হয়েছে।
আবদুল মোক্তাদির, সভাপতি, ওষুধশিল্প মালিক সমিতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস