দেশে পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা চলছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আবাসন খাতে। সেই সঙ্গে নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপের ধাক্কাও লেগেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়সহ আবাসন খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।
বর্তমানে আবাসন খাতে ব্যবসার কী অবস্থা?
মো. ওয়াহিদুজ্জামান: দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে আবাসন খাতের ব্যবসা ভালো হয়। দেশে গত আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে একধরনের স্থবিরতা চলছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে আবাসন খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
যদি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া যায়, তাহলে আবাসন খাতের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও চাঙা হবে। এ ছাড়া গৃহঋণের জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবারও ১০ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল চাই।মো. ওয়াহিদুজ্জামান সভাপতি, রিহ্যাব
আপনারা অনেক দিন ধরেই বলছেন, নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০২২-৩৫) আবাসন খাতের ব্যবসায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটির কারণে কি নতুন আবাসন প্রকল্প কম আসছে?
মো. ওয়াহিদুজ্জামান: নতুন ড্যাপের কারণে মূল ঢাকায় ভবনের উচ্চতা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। জমির মালিক ও আবাসন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা আশায় আছেন, প্রস্তাবিত ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করা হবে। সে জন্য সবাই অপেক্ষায় আছেন। ভবনের উচ্চতা বা ফ্ল্যাটের সংখ্যা কম হবে, এমন আশঙ্কায় আবাসন প্রকল্প অনুমোদনের আবেদন খুবই কম জমা পড়ছে। যে কারণে অ্যাপার্টমেন্ট সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। ফলে বর্তমানে চাহিদা থাকলেও সে অনুযায়ী অ্যাপার্টমেন্ট নেই।
নতুন ড্যাপের সংশোধন হওয়া নিয়ে আপনারা কতটা আশাবাদী?
মো. ওয়াহিদুজ্জামান: আমাদের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ রিহ্যাবের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ড্যাপ সংশোধনের বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।বিগত সরকারের পাশাপাশি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও আমরা বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, আবাসন খাত নিয়ে কোনো ধরনের ইতিবাচক গবেষণা নেই। অনেকেই মনে করেন, আমরা কেবল বাড়িই বানাই। অথচ আবাসন খাতের সঙ্গে দুই শতাধিক সংযোগ শিল্প জড়িত। আবাসন খাতে ধস নামলে এসব সংযোগ শিল্পের ব্যবসাও তলানিতে নামে। অর্থনীতিতে আবাসন খাতের প্রভাব নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় নতুন ড্যাপ সংশোধনেও একধরনের অবহেলা দেখা যায়।
এ ছাড়া আমাদের মনে হয়, স্বার্থান্বেষী একটি মহল চায় না যে ড্যাপে সংশোধন আসুক। সে জন্য তারা বিভিন্নভাবে ড্যাপের সংশোধন রোধে চেষ্টা-তদবির করছে। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ড্যাপ বাস্তবায়নের তদারকি ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধনীর সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে। এর ফলে ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা চূড়ান্ত করার বিষয়টি আবারও বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা অবশ্যই বিষয়টি থেকে পিছপা হব না। কারণ, ড্যাপ সংশোধন না হলে শুধু ঢাকার জমির মালিকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, সেই সঙ্গে কৃষিজমি দ্রুত শেষ হবে। এ ছাড়া আগামী দিনে আমরা ব্যবসা করে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারব কি না, সেটি ড্যাপ সংশোধনের ওপর অনেকটা নির্ভর করছে।
জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ড্যাপে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এখানে আপনাদের দ্বিমত কোথায়?
মো. ওয়াহিদুজ্জামান: নতুন ড্যাপে রাজউকের নিজস্ব ইজারায় জমি রয়েছে, এমন সব এলাকায় ভবনের উচ্চতা বেশি দিয়ে রাখা হয়েছে । অথচ অন্য এলাকাগুলোয় ভবনের উচ্চতা কম রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। তা-ও আবার ভবনের উচ্চতা এতটাই কম দেওয়া
হচ্ছে যে জমির মালিকেরা সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। ঢাকার জমির দাম অনেক বেশি। জমির স্বল্পতাও আছে। যখন ভবনের উচ্চতা কমবে, তখন ফ্ল্যাট কম হবে। এতে ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে। এই বাড়তি দামের চাপটা কিন্তু পড়বে ক্রেতাদের ওপর। সে জন্য নতুন ড্যাপকে আমরা বৈষম্যমূলক বলেছি। এটি সংবিধানেরও লঙ্ঘন। যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার দোহাই দেওয়া হয়েছে, সেগুলো তো চাইলেই বাড়ানো সম্ভব। মেট্রোরেল চালুর পর মতিঝিল-মিরপুর সড়কে গাড়ির চাপ কমে এসেছে। এভাবে অন্যান্য এলাকায় যাতায়াতব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি নাগরিক সুবিধা বাড়ানো সম্ভব।
বহু আগে থেকেই ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্টের দাম আকাশচুম্বী। স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছাড়া অনেকের পক্ষে এখন আর অ্যাপার্টমেন্ট কেনা সম্ভব না। এমন কোনো ব্যবস্থার জন্য আপনারা কি এখন আর সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন?
মো. ওয়াহিদুজ্জামান: উচ্চমূল্যের কারণে মধ্যবিত্তের জন্য ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনা আসলেই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই ২৫-৩০ বছরের জন্য গৃহঋণ দেওয়ার জন্য মর্টগেজ করপোরেশন রয়েছে। সেসব দেশের ফ্ল্যাটের ক্রেতারা ৩০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করে মর্টগেজ করপোরেশনে আবেদন করেন। তখন ওই সংস্থা তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থায় যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, অ্যাপার্টমেন্টে লোন বা গৃহঋণ দেওয়া সব সময়ই ঝুঁকিমুক্ত। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, রাঘববোয়ালেরা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। সেই ঋণ খেলাপিও হয়ে পড়েছে। ব্যাংক আদৌ টাকা ফেরত পাবে কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। মধ্যবিত্তরা আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে যদি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া যায়, তাহলে আবাসন খাতের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাঙা হবে। গৃহঋণের জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবারও ১০ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল চাই। একটা সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এমন একটি তহবিল ছিল। কয়েক বছর সফলভাবে চলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি) এখনো গৃহঋণ দিচ্ছে। তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েও গৃহঋণের সমস্যাটি সমাধান করা যায়।
স্বল্প আয়ের মানুষের আবাসন-সুবিধা নিশ্চিতে কী করতে হবে?
ওয়াহিদুজ্জামান: প্রথমেই বলব, আবাসন খাতের জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা দরকার। আগামী ৩০ বছরে যেন হাত দিতে না হয়, সেভাবে সুপরিকল্পিতভাবে ড্যাপ ও অন্যান্য পরিকল্পনা করা দরকার। অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ে প্লট প্রকল্প করা যাবে না। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঢাকায় সব করতে চাইলে চাপ বাড়বে। পূর্বাচলের মতো ঢাকার বাইরে আরও বেশ কিছু আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। এসব করলেই কেবল স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য আবাসন সমস্যা ধীরে ধীরে কমে আসবে।