৬ জুন ঘোষিত হতে যাচ্ছে নতুন বাজেট। নতুন বাজেটে কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতেই বা করণীয় কী—এ নিয়ে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।
দেশের সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রথম চাওয়া আগামী বাজেটে নিত্যব্যবহার্য খাদ্যপণ্য, বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের খরচ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া। এটাও আমরা জানি, সরকারের বাড়তি বা নতুন করের উৎস খুবই কম। তা সত্ত্বেও আমি মনে করি, উচ্চাভিলাষী বা অনুৎপাদনশীল বিভিন্ন খাতের খরচ কমিয়ে সেই অর্থ সাধারণ মানুষের মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে ব্যবহার করতে পারি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ কমানো আগামী বাজেটে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আমরা প্রায়ই দেখি, বাংলাদেশে সম্পূরক শুল্ক বা সাপ্লিমেন্টারি ডিউটির ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রীতিনীতির পরিপন্থী। তার চেয়েও বড় কথা, এ মুহূর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সম্পূরক শুল্ক কমালে তাতে দাম কিছুটা কমবে। প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আপাতত বিলাসবহুল কোনো প্রকল্প হাতে না নেওয়ার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে কতটা কার্যকর করা হচ্ছে, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ, এখনো আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখি, বিশাল বিশাল ভবন তৈরি করা হচ্ছে। নতুন নতুন গাড়ি কেনা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন। এগুলো এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য আদৌ প্রয়োজন, নাকি এসব অর্থ আমরা অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করতে পারি, সেটা দেখা দরকার।
আমরা এটাও জানি, বিদ্যুৎ খাতে আমরা বর্তমানে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছি। যার বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ। সেখানে নতুন করে কী করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে আগামী বাজেটে। বিদ্যুৎ খাত থেকে যদি কিছু ভর্তুকি কমানো যায়, তাহলে অতিপ্রয়োজনীয় খাতে তা ব্যয় করা যাবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। চিকিৎসা বাবদ প্রতিবছর দেশে থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যায়। যার বেশির ভাগই যায় অবৈধ পথে। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ কীভাবে দেশে রাখা যায়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ থাকা দরকার বাজেটে। এ জন্য স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বড় বড় যেসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে হবে। ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের বড় হাসপাতালগুলোকে যদি এ দেশে আনা যায়, তাহলে এ দেশের হাসপাতালের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মানও উন্নত হবে। চিকিৎসা ব্যয় নাগরিকদের সামর্থ্যের মধ্যে আনতে বাজেটে পদক্ষেপ থাকা দরকার। পাশাপাশি শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নত করতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশের একজন সাধারণ নাগরিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে আমার আরেকটি প্রত্যাশা, পরিবহন খরচ কমাতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অভ্যন্তরীণ পরিবহন খরচ দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ সময় তেলের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে এ খরচ বাড়ানো হয়। কিন্তু আমরা দেখছি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যতটা বাড়ে, তার চেয়ে বেশি বাড়ে দেশে। তাতে পরিবহন খরচও বাড়ে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জাহাজ ও উড়োজাহাজের ভাড়া যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছি। উৎপাদন খরচ আমরা যতটা না কমাতে পারছি, তার চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে লজিস্টিকের পেছনে। সরকার সম্প্রতি একটি লজিস্টিক নীতিমালা করেছে। বাজেটে সেটিরও প্রতিফলন থাকতে হবে। জ্বালানি সাশ্রয়ী পরিবহনে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ দরকার।
ব্যবসায়ী হিসেবে আগামী বাজেটে আমি দার্শনিক পরিবর্তন আশা করি। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কীভাবে বাড়ানো যায়, তার দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। এনবিআর রাজস্ব আয় বাড়াতে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়, তাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টি কতটা বিবেচনা করা হয়, সেটিও আমার প্রশ্ন। কর্মসংস্থান এখন বিশ্বজুড়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানহীন যে প্রবৃদ্ধির ধারা চলছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আগামী বাজেটে আমি দার্শনিক দিকনির্দেশনা আশা করি। এ ছাড়া ব্যবসার খরচ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা দেখি, এখনো বিভিন্ন ধরনের সনদের কর, করের ওপর কর, লভ্যাংশের ওপর দ্বৈত কর ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। যাতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মুনাফা বাড়ে। কারণ, মুনাফা বাড়লেই কোম্পানির বিনিয়োগ বাড়বে।