বিশ্লেষণ

কতটা সফল হয়েছে ব্রিকস

ব্রিকস সম্মেলন মঞ্চে (বাঁ থেকে) ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও। গতকাল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের স্যান্ডটন সম্মেলন কেন্দ্রে
ছবি: এএফপি

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে শুরু হয়েছে বিকাশমান পাঁচ অর্থনীতির জোট ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলন। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার (ব্রিকস) এই জোট এখন বিশ্ব মঞ্চে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে সদস্যদেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কও খুব সহজ নয়।

জোহানেসবার্গের এই সম্মেলনের অন্যতম আলোচ্য বিষয় জোটে যোগ দেওয়ার জন্য কিছু আবেদন বিবেচনা করা। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, ‘সম্প্রসারিত ব্রিকস বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থাসংবলিত বৈচিত্র্যপূর্ণ কিছু জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করবে, যাদের আরও ভারসাম্যপূর্ণ একটি বিশ্বব্যবস্থার জন্য একক অভিলাষ রয়েছে।’

তবে ব্রিকস সম্প্রসারণের কাজটি খুব সহজে হবে না। একটি আদর্শ সুখী পরিবারের উদাহরণ ব্রিকস নয়। ব্রিকসের সম্প্রসারণ সম্ভবত জোহানেসবার্গে হবে না। একই সঙ্গে নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা ব্রিকসের কোনো কোনো দেশের রয়েছে, তা কতটা অর্জিত হবে, সেটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। জোটে চীন ও রাশিয়ার উপস্থিতির কারণে এর একটি পশ্চিমাবিরোধী চরিত্র নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন।

স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়েছে, ২২টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে আবেদন করেছে। আরও ২০টি দেশ যোগ দিতে আগ্রহী। ব্রিকসের নতুন সদস্য হতে চায় এমন দেশের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, আর্জেন্টিনা, মিসর, ইরান, কিউবা, কাজাখস্তান ও বাংলাদেশ। এই দেশগুলোর প্রায় সবাই উদীয়মান অর্থনীতির দেশ এবং এরা আরও বেশি বাণিজ্য করতে চায়, চায় আরও বেশি বিনিয়োগ। তবে কারও কারও ভূরাজনৈতিক স্বার্থও রয়েছে, রয়েছে পশ্চিমাবিরোধী অবস্থান।

ব্রিকস সদস্যদের অবস্থা

গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন জিম ও’নিল। তিনি একসময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সরকারের অর্থ বিভাগের কনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস–এ তিনি লিখেছেন, ব্রিকস তাঁকে ‘হতাশ’ করছে।

ব্রিকসের মূল্যায়ন করা সম্ভবত তাঁকেই সবচেয়ে বেশি মানায়। ২২ বছর আগে তিনি একটি গবেষণা প্রবন্ধে চারটি বিকাশমান অর্থনীতির দেশকে একটি নতুন শব্দে বর্ণনা করেছিলেন—ব্রিক, যা ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া ও চীনের আদ্যক্ষর নিয়ে গঠিত। এর কয়েক বছর পর ওই চার দেশ একটি জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে জোটের পরিচিতি দাঁড়ায় ব্রিকস।

জিম ও’নিল বছর দুয়েক আগে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস–এ লেখেন, ব্রিক দেশগুলোর মধ্যে কেবল চীন তাদের প্রবৃদ্ধির অভিক্ষেপকে ছাড়িয়ে গেছে, ভারতও খুব একটা পিছিয়ে নেই। তবে ২০০১ সালের তুলনায় একেবারেই ভালো করতে পারেনি ব্রাজিল ও রাশিয়া। তাঁর কথায়, ‘এসব দেশ কীভাবে তাদের পুরো জনগোষ্ঠীকে উচ্চতর আয়ের স্তরে সফলভাবে নিয়ে যেতে পারে, সেই বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়টিই অমীমাংসিত রয়ে গেছে।’

জিম ও’নিলের এই নেতিবাচক মূল্যায়নের অবশ্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাঁর ভাবনার পরের প্রথম দশকে সব দেশই ভালো করেছিল। যেমন চীনে ১৭৬ শতাংশ, ভারতে ১১০ শতাংশ, রাশিয়ায় ৬০ শতাংশ, ব্রাজিলে ৪৭ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪১ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু তারপরই যেন ছন্দ হারায় জোট, বিশেষ করে ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেওয়ার পর।

পরের এক দশকে অর্থাৎ ২০২২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি হয় ১৩ শতাংশ, আর ব্রাজিলের ৭ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ১২ শতাংশ। তিনটি দেশকেই অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। চীন ও ভারত ভালো করেছে, তবে তাদেরও অর্থনীতির গতি ধীর হয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক দিনের ক্ষোভ হচ্ছে, তাদের চাহিদার বিষয়টি শক্তিশালী অর্থনীতিগুলো বুঝতে চায় না। তারা প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আন্তর্জাতিক রীতিনীতি নিজেদের স্বার্থে ভাঙার জন্য অভিযুক্ত করে থাকে।

তবে চীন নিয়েও উদ্বেগ আছে। যে জোটে চীন রয়েছে, সেখান থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো কী পাবে, তা নিয়ে অনেক দেশই সন্দিহান। কারণ, চীনের নিজস্ব অভিলাষ রয়েছে। শুধু অভিলাষই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধও চলছে। চীন নিজে একটি সুপারপাওয়ার হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে রাশিয়া বিশ্বসমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন।

কী অর্জিত হলো

ব্রিকসের অর্জন খুব বেশি নয়। সবচেয়ে বড় অর্জন একটি ব্যাংক। ২০১৫ সালে গঠিত হয় নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এই ব্যাংক এখন পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক শুধু ২০২২ সালেই দিয়েছে ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ।

জোট হিসেবে ব্রিকসকে পিছিয়ে রেখেছে ভারত ও চীনের পারস্পরিক সম্পর্ক। দেশ দুটির মধ্যে বড় আকারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। গত বছর তাদের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। তবে তাদের সীমান্ত শান্ত নয়, ২০২০ সালে সংঘর্ষেও জড়িয়েছিল তারা। ভারত মনে করে, চীন তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দিল্লি সম্প্রতি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলো মূলত বেইজিংকে লক্ষ্য করেই নেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য খর্ব করা।

কিন্তু ব্রিকসকে একটি অমিত সম্ভাবনার জোট বলে মনে করা হয়। বিশ্বের ৪২ শতাংশ জনসংখ্যার বাস ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোতে। ২০৩০ সালে বৈশ্বিক জিডিপির অর্ধেকের বেশি এসব দেশ থেকে আসতে পারে। সদস্যদেশগুলো নিজেদের মধ্যেও বড় পরিমাণে বাণিজ্য করে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য আরও বেড়েছে। রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারছে না। ফলে সস্তায় পণ্য বিক্রি করছে চীন ও ভারতের মতো দেশের কাছে।

তবে ব্রিকস জোট সত্যিকার অর্থে একদিকে হেলে রয়েছে। চীনের অর্থনীতির আকার এখন ১৯ ট্রিলিয়ন বা ১৯ লাখ কোটি ডলার, যা ব্রাজিলের তুলনায় ৫০ গুণ বড়। পৃথিবীর বেশির ভাগ বড় অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য চীনের পক্ষে থাকলেও রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সাম্প্রতিক বাণিজ্য ভারসাম্য দেশটির বিপক্ষে। ব্যতিক্রম ভারত। ২০২২ সালে ভারত থেকে আমদানির তুলনায় সে দেশে চীনের রপ্তানি ১০ হাজার কোটি ডলার বেশি ছিল।

বাণিজ্য সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিকসের অন্যতম ঘোষিত নীতি হলো একটি বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এটা বেশি করে চাইছে চীন ও রাশিয়া। ব্রাজিলের বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভাও তাতে সমর্থন জানাচ্ছেন, সঙ্গে চাইছেন ডলারের বাইরে একটি লেনদেনব্যবস্থা চালু করতে।

নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা

জোহানেসবার্গ সম্মেলনে যেসব বিষয় আলোচনায় আসবে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে, বৈশ্বিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফটের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা তার একটি। ডলারবিহীন আর্থিক ব্যবস্থা ও ব্রিকস পে নামে একটি লেনদেনব্যবস্থা গড়ে তোলা, নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করে বাণিজ্য করা এবং একসময় নিজেদের একটি একক মুদ্রা চালু করা—এসবই আছে ব্রিকসের অভিলাষের তালিকায়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়েছে, ব্রিকস মুদ্রা নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হবে না।

জোহানেসবার্গে ডলারের বিপক্ষে ব্রিকসের কোনো কোনো সদস্যদেশের নেতা যে উচ্চ কণ্ঠ হবেন, এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ডলার–সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশই কঠিন সময় পার করছে। এদের অনেকেই ডলারের একক আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। অন্যদিকে বিদেশে রাখা রাশিয়ার সম্পদ জব্দ হওয়ার কারণে চীন কিংবা কর্তৃত্ববাদী কিছু দেশ উদ্বিগ্ন।

চীনের ইউয়ান আর ভারতের রুপিতে কিছু বাণিজ্য ইদানীং শুরু হয়েছে। তবে সমস্যা হলো, ইউয়ান কিংবা রুপি কোনোটিই পুরোপুরি রূপান্তরযোগ্য নয়। আর ভারত ইউয়ান ব্যবহারে খুব একটা আগ্রহী নয়। তারা চায় রুপির আন্তর্জাতিকীকরণ। সে লক্ষ্যে দেশটি সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু করেছে।

কতটুকু অগ্রগতি হবে

চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বেশ খারাপ। চীনের নিজস্ব অভিলাষ রয়েছে। ভারতেরও রয়েছে চীনের বিকল্প হিসেবে বৈশ্বিক উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার ইচ্ছা। রাশিয়া পশ্চিমাবিরোধী মিত্র চায়। এই অবস্থায় ব্রিকস কী অর্জন করতে পারে, তা নিয়ে সন্দেহ কাটছে না।

উচ্চ আয়ের স্তরে পৌঁছাতে আগ্রহী দেশগুলোর জন্য অবশ্য জিম ও’নিল দুই বছর আগেই একটি পরামর্শ দিয়েছেন, তা হলো দক্ষিণ কোরিয়াকে অনুসরণ করা। তাঁর মতে, ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও নাইজেরিয়াকে যদি বৃহত্তর সমাজের জন্য সাফল্য আনতে হয় তাহলে তাদের উচিত অর্থনীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়াকে অনুসরণ করা। তবেই কেবল এসব দেশের নাগরিকেরা আরও বেশি সম্পদশালী এবং সম্ভবত সুখী হবেন।