তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি জায়গায় খুব মিল ছিল। বলা যায়, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে শেখ হাসিনার মিল। এই মিল মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে। দুজনই দীর্ঘ সময় উল্টো পথে হেঁটেছেন। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির ছোবল থেকে বাঁচতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ যেসব ব্যবস্থা নিয়েছিল, তাঁরা দুজন সে পথে যাননি। এ ফল হয়েছে মারাত্মক। দুটি দেশের সাধারণ মানুষই মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হয়েছেন, যে ক্ষত এখনো অনেকে সামলে উঠতে পারেননি।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক নীতি পরিচিতি পেয়েছে ‘এরদোয়ানোমিকস’ হিসেবে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নীতিকে কোনো বিশেষ নামে চিহ্নিত করার সাহস সম্ভবত কেউ করেননি। এরদোয়ানোমিকস নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, বিশেষ করে ২০২২ সালের অক্টোবরে যখন তুরস্কে মূল্যস্ফীতি ৮৬ শতাংশ উঠে যায়। ঠিক সেই সময়ে যখন পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে সুদের হার বাড়িয়ে চলেছিল, তুরস্ক করেছিল উল্টোটি। তারা সুদের হার কমিয়ে দেয়। সুদ নিয়ে তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস ছাড়াও এরদোয়ান মনে করতেন, সুদের হার বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়ে।
বাংলাদেশে সুদের হার কমিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে ‘নয়–ছয়’ নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ, আর আমানতের সুদ সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। ফলে ঋণ নেওয়া সস্তা হয়। দেদার ঋণও নেন ব্যবসায়ীরা। বাজারে বাড়ে মুদ্রা সরবরাহ। সঙ্গে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি।
গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার আরও এক দফা বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা কার্যকর হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো হার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে বাড়বে ঋণ করার খরচ, যদিও আমানতকারীরাও এর ফলে লাভবান হবেন। তাঁরা গচ্ছিত অর্থে আগের চেয়ে বেশি মুনাফা পাবেন এটা আশা করা যায়। নীতি সুদহার বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা। সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১৩ বছরের বেশি সময় পরে জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়েছে—১২ শতাংশের অনেকটা কাছে পৌঁছে গেছে।
তুরস্কে অন্তত মূল্যস্ফীতির সঠিক পরিসংখ্যান দেয়। আগের সরকারের আমলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, তার সত্যতা নিয়ে অনেক দিন ধরেই অর্থনীতিবিদসহ অনেকের মধ্যে সংশয় ছিল। জুন মাসেও সরকারি মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ শতাংশের নিচে। মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে যে লুকোচুরি ছিল, তা প্রকারান্তরে নিশ্চিত করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ আগস্ট সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হবে। এরপরে জুলাই মাসের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়, তাতে মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে বলে দেখা যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখন সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কতটা কাজ দেবে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে শুরু করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর, যখন রাশিয়া প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালায়। বিশ্বে জ্বালানির দাম বাড়ে, সরবরাহব্যবস্থায় বাধা তৈরি হয়, দাম বাড়ে ডলারের। ফলে পণ্যের মূল্য হয় ঊর্ধ্বমুখী। সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া। বিশ্বের বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তাদের সেই দায়িত্ব পালনে তৎপর হয়। তাদের হাতিয়ার ছিল মুদ্রানীতি, দফায় দফায় সুদের হার বাড়ায় তারা। উদ্দেশ্য ছিল, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনা। ব্যতিক্রম ছিল গুটিকয় দেশ—যেমন তুরস্ক ও বাংলাদেশ।
ব্যাংকের মালিকদের উদ্যোগে ও সরকারি সিদ্ধান্তে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, যা বজায় ছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। বাংলাদেশে যখন সুদের হার মাত্র বাড়ানো শুরু হয়, তখন বিশ্বের অনেক দেশই সুদের হার অনেক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য, মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। ফলে গত ২৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রথাগত এই পথ অনুসরণ করেছে বিশ্বের প্রায় সব দেশই। মোটামুটি প্রায় সবাই সফল হয়েছে এ কাজে। এখন বরং সুদের হার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রথাগত পথে অনেক দেরিতে পা রাখে বাংলাদেশ। এখন নীতি সুদহার ৯ শতাংশে পৌঁছার কারণে সব ধরনের সুদের হার আরও বাড়বে। বাড়বে ঋণ করার খরচও। ফলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। কিন্তু মাসের পর মাস ধরে ৯ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে এর বিকল্প নেই। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হলে এই হার আরও বেশি হতে পারে, এই বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
তবে মূল্যস্ফীতির রাশ টানার এই হাতিয়ার এখন কাজ করবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার এর আগে কয়েক দফায় বাড়ানো হলেও এই অস্ত্র যে খুব একটা কাজে লাগছে না, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমেনি। সময়মতো এই অস্ত্র প্রয়োগ করা হলে হয়তো সুফল পাওয়া যেত। নতুন সরকারকে এখন ভিন্নভাবে ভাবতে হবে।
নীতি সুদহার কমানোর প্রভাব খুব দ্রুত মূল্যস্ফীতিতে পড়বে না এটা মেনে নিয়ে নজর দিতে হবে বাজার ব্যবস্থাপনায়। সরকারের হাতে প্রশাসনিক যেসব বিকল্প আছে, সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তথাকথিত সিন্ডিকেট ভাঙা, বাজার ও আমদানিব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা, ঋণপত্র খোলার বাধাগুলো দূর করা, চাঁদাবাজদের ফিরে আসার পথ বন্ধ করা—বাজার ব্যবস্থাপনায় এসব বিষয় বিবেচনায় আনা দরকার।
ডলারের দাম বাড়ায় আমদানির খরচও বেড়েছে। ফলে সরকারের আমদানি শুল্ক বাবদ আয়ও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানুষকে স্বস্তি দিতে শুল্কের হারে যতটা সম্ভব ছাড় দেওয়ার সময় এসেছে। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও সরবরাহ–সম্পর্কিত তথ্য–উপাত্ত সততার সঙ্গে প্রকাশ করতে হবে।
নীতি সুদহার আরও এক দফা বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। বাকি বেশ কিছু কাজ করতে হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সমন্বিত চেষ্টার মাধ্যমে পুরোনো পাপের মোচন কিছুটা হয়তো সম্ভব হতে পারে।
ওয়ালিউর রহমান
প্রধান বাণিজ্য সম্পাদক, প্রথম আলো